সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির চক্রে উন্নয়ন প্রকল্প

সরকারের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পই যথাসময়ে, নির্ধারিত টাকায় শেষ হচ্ছে না। এটা পুরোনো খবর। বারবার সময় বাড়ছে, ব্যয় বাড়ছে, কাজের মান খারাপ হচ্ছে, জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এ–ও পুরোনো তথ্য। নতুন হলো, সরকারের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন এটা নিয়ে ভাবছে। বলছে, দশকজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্প একই চক্রে ঘুরপাক খাওয়ায় সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে এই গোলকধাঁধা তৈরির পেছনে দুর্নীতির কোনো যোগ আছে কি না, সরকারি আলোচনায় সে প্রসঙ্গ এখনো আসেনি।

বস্তুত গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার পর এ নিয়ে কথাবার্তা বাড়ছে। এর মাসখানেক আগেও একবার প্রধানমন্ত্রী একই বিষয়ে নিজের অসন্তুষ্টির কথা জানান।

তবে সময়ে সময়ে বিশেষ করে জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নকাজের ধীরগতি নিয়ে কথা বলেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় বৃদ্ধি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। নির্ধারিত সময় ও ব্যয়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত এখন নেই বললেই চলে।

এর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের ধীরগতি এবং ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশি আলোচনা হয়েছে। গত দুই মাসে একাধিক সংসদীয় কমিটির আলোচনায় রেলপথ মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পেও একই সমস্যার কথা উঠে এসেছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়

২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে মোট ৯৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ সভায় এই প্রকল্পগুলো নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাতে দেখা যায়, এই ৯৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৮টির সময় এক বা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। ২৮টি প্রকল্পের সময়সীমা নিয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। মাত্র ১৬টি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে। চারটি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়ও বেড়েছে।

ঢাকার কাছের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্দিষ্ট ছিল তিন বছর। তিন দফায় এক বছর করে তিন বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। একবার প্রকল্প সংশোধন ও একবার আন্তখাত সমন্বয় করা হয়। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লেগেছে মোট সাত বছর। সময়ের পাশাপাশি এই প্রকল্পে খরচ বেড়েছে (কস্ট ওভাররান) ২০০ শতাংশ। আর সাত বছর ধরে এই পথে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছে।

শুধু এই প্রকল্প নয়, পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পে শুরু থেকে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের মতো ছোট প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো আর খরচ বাড়ানো হয়ে গেছে স্বাভাবিক ঘটনা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য কোনো জবাবদিহি করার তথ্য নিকট অতীতে জানা যায়নি। তিরস্কারের কথাও শোনা যায়নি। যাদের অর্থে উন্নয়ন হচ্ছে, কেবল সে মানুষেরা ভুগে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে সে খবর গণমাধ্যমে আসে।


প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি নিয়ে তাঁকে বেশির ভাগ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জমি অধিগ্রহণসহ বাস্তবতার নিরিখে নতুন কাজ যুক্ত করার মতো কারণে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রকল্পের ব্যয় ও সময়সীমা বাড়তে পারে। কিন্তু সব প্রকল্পে কেন এমন হবে। মন্ত্রী বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে যথাযথভাবে চাহিদা নিরূপণ করতে না পারা এবং দক্ষ জনবলের অভাবও দায়ী।


আইএমইডির প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, বারবার প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বাড়ানোর ফলে অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মান রক্ষা করা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে বারবার প্রকল্প পরিচালক বদল করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি কয়েকটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে কাজের গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না। যথাযথ পরিকল্পনা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। অনেক দেশেই এমন হয়। তবে বাংলাদেশে এই প্রবণতাটা বেশি। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই না এই ধারা অব্যাহত থাকুক।’
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০০২ সালের জুলাই মাসে। ২০০৬ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একাধিকবার প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর। চার বছরের প্রকল্প শেষ হয়েছে ১৭ বছরে। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৩৯ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৭৯৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ বেড়েছে ৮১ শতাংশ, আর সময় বেড়েছে ৩৩৭ শতাংশ। সময় ও ব্যয় বাড়ার বড় কারণ ছিল বৈদেশিক ঋণের জটিলতা। আইএমইডি বলেছে, এই প্রকল্পে এত সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং–নবীগঞ্জ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি চার বছরে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে প্রকৃতপক্ষে সময় লেগেছে আট বছর। তিনবার এই প্রকল্পের পরিচালক বদল হয়েছে। একইভাবে ভোলার চরফ্যাশন–চরমানিকা–বাবুহাট লঞ্চঘাট সড়ক নির্মাণ, গাজীপুর–আজমতপুর–ইটাখোলা সড়ক নির্মাণ প্রকল্পসহ অনেকগুলো প্রকল্পেই দ্বিগুণ সময় লেগেছে। বেড়েছে খরচও।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়

স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্প ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রামীণ সড়ক ও হাটবাজার অবকাঠামো উন্নয়ন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল অনুমোদিত সময়ের চেয়ে সাড়ে চার বছর বেশি লাগে। এতে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়।


সংসদীয় কমিটি সূত্র জানায়, ২০১৮–২০১৯ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এগুলো মূলত গ্রামীণ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর) পায়নি আইএমইডি। বাকি ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১০টির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।


২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২৪টি প্রকল্প শেষ হয়। এগুলোর মধ্যে অন্তত ১৩টি প্রকল্পে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়।


সূত্র জানায়, গত মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একজন সদস্য বলেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি সেতু নির্মাণের জন্য তিন বছর সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সেতু হয়নি। ওই ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত না করে পাশের উপজেলার আরেকটি সেতু নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

গত জানুয়ারিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চলমান বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছিল জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব কমিটি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডি) প্রকল্প’ শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। প্রকল্পের জন্য ১টি ফোর হুইলার, ৫টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ১টি মাইক্রোবাস ও ৪১৮টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। গাড়ি কেনা ছাড়া তেমন কোনো কাজ হয়নি ওই প্রকল্পে।

গরুর পিপিআর রোগ নির্মূল এবং খুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি। ২০২২ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। গত নভেম্বর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২ শতাংশ। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের জুনে। ২০২৩ সালের জুনে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। কাজ হয়েছে ১০ শতাংশ।


মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের ‘দুরবস্থা’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব কমিটি। কমিটি বলেছিল, প্রকল্পকাজে ধীরগতি এবং আর্থিক সুশাসন না থাকায় সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়

গত ডিসেম্বরে অনুমিত হিসাব কমিটির বৈঠকে রেলওয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে রেলপথ মন্ত্রণালয় তাদের চলমান ৩৯টি প্রকল্পের (অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত হালনাগাদ) তথ্য দিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ওই ৩৯টি প্রকল্পের ১১টির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পে নতুন কাজও যুক্ত করা হয়। শুরুতে এই ১১ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল সব মিলিয়ে ৫১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এখন ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সময় বাড়ার পাশাপাশি এসব প্রকল্পের অনুমিত খরচ বেড়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বস্ত্র অধিদপ্তরের সাতটি প্রকল্প চলমান আছে। সব কটি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন প্রকল্প। সাতটি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি ইতিমধ্যে দুই থেকে তিনবার সংশোধন করা হয়েছে। সব কটিতেই সম্ভাব্য ব্যয় বেড়েছে।


সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রকল্প হাতে নেওয়া। যথাযথ পরিকল্পনা, প্রস্তুতি শেষ না করেই প্রকল্প নেওয়া। সে জন্য বড় বড় প্রকল্পে মাঝপথে এসে নকশায় ত্রুটি দেখা গেছে। তিনি বলেন, প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারলে কারও বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমন নজির নেই। আবার নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করলে পুরস্কৃত করাও উচিত। এখানে কোনোটিই হয় না।