সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে পিছিয়ে দেশ

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ-ইউএইচসি) অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। আগামী জুনের মধ্যে যে দিশারি প্রকল্প শেষ করার কথা, তা এখনো শুরুই করতে পারেনি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
একাধিক আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ইউএইচসি অর্জনে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১১টি দেশের ইউএইচসি অর্জন পরিস্থিতি নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। ‘মুভিং টুওয়ার্ডস ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ: লেসনস ফরম ১১ কান্ট্রি স্টাডিজ’ শীর্ষক ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ করণীয় ঠিক করছে, দিশারি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশটিতে খুব কম মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যাং ২০১২ সালে জেনেভায় ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে বলেছিলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে এককভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ধারণা হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা।’ ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’র উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা হচ্ছে, সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা কিনতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়বে না। উদ্দেশ্য অর্জনে কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে। স্বাস্থ্যবিমা মানুষকে সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে। ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধারণা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে।
ইউএইচসি নিয়ে পিছিয়ে পড়ার ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সবার ধারণা একপর্যায়ের নয়। ইউএইচসির সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবে, তা-ও অনেকে বুঝে উঠতে পারছেন না।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার জন্য একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে অপচয় কমানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দিশারি প্রকল্প শিগগিরই শুরু হবে।
আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন: ল্যানসেট-এর প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এই উদ্যোগ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। এ উদ্যোগে বড় বাধা স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য জনবলের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান) ৯৪ শতাংশই অদক্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখা কঠিন।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য পাথ টু ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ইউএইচসি অর্জন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বাড়তি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ জনবলের জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মী ধরে রাখার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা: স্বাস্থ্য খাতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিলের একাধিক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের একাধিক নির্দেশনা দিয়েছেন বলে সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়।
২০১৪ সালের ১৯ জুনের সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সব ব্যবস্থা নিতে হবে। এ লক্ষ্যে আর্থিক ও অন্যান্য বাধা দূরীকরণে স্বাস্থ্যবিমা চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও একাধিক নির্দেশনার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি। এ বিষয়ে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি’ নামে একটি দিশারি প্রকল্প তৈরি করা হয় ২০১২ সালে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী ও কালিহাতী উপজেলায় দিশারি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল। কথা ছিল, ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হবে। এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে এ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের মানুষ আসবে। গত বছর ২০ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে মাঠপর্যায়ে দিশারি প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কিন্তু এখনো কাজ মাঠে নামাতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, ওই তিনটি উপজেলার ভূমিহীন, শুধু ভিটেবাড়ি আছে এমন এবং দিনমজুর শ্রেণির এক লাখ পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা হবে। এসব পরিবারের সদস্যরা ৫০টি রোগের বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন। চিকিৎসা-ব্যয় মেটাতে সরকার পরিবারপ্রতি বছরে এক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দেবে। আর প্রতিটি পরিবার চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার সুবিধা পাবে। এ জন্য গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ কোম্পানি বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপকারভোগীদের নাম নিবন্ধন, স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ, কার্ডধারী রোগীদের সেবা পেতে সহায়তা করা এবং হাসপাতালের খরচ মেটাতে সাহায্য করবে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেছেন, আগামী মার্চে দিশারি প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
ঠিকভাবে কাজ করেনি: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে বেশ কয়েকটি এনজিও ও সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি সহায়তা নিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এগুলোও ঠিকভাবে কাজ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রকেফেলার ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পিপিআরসি, আইসিডিডিআরবিসহ মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়। সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের মূল্যায়ন হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানই তাদের কাজ শতভাগ শেষ করতে পারেনি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ১০ শতাংশ কাজও করেনি। এসব কাজ মূল্যায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, এনজিওদের তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ ভালো করেছে।
রকেফেলার ফাউন্ডেশন তাদের মূল্যায়নে বলেছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে সরকারি পর্যায়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্ব দরকার। এ কাজকে এগিয়ে নিতে প্রাতিষ্ঠানিক জোর প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর অভাব আছে।