মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যায় ফাতেমা আক্তারের। সংসার সামলানোর পাশাপাশি তিনি ভাবতে থাকেন, নিজ থেকে কিছু করা যায় কি না। এ সময় তিনি খোঁজ পান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মসংস্থানবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সম্বন্ধে। তিনি ব্লক, বাটিক তৈরি ও মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
২০১৭ সালে ঋণ নিয়ে ফাতেমা আক্তার প্রতিষ্ঠা করেন জলি বুটিকস অ্যান্ড ফুড কর্নার। সেখানে পোশাক, ব্লক, বাটিক ও ক্যাটারিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন সেখানে কাজ করেন দুজন প্রশিক্ষকসহ পাঁচ নারী। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত ২৫০ জন। আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জনের।
প্রশিক্ষণ ও ঋণসহায়তা পেলে তৈরি হয় আত্মকর্মসংস্থানের। পাশাপাশি দ্বার খোলে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার। আর সে লক্ষ্যেই কাজ করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। এখান থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে ফাতেমা আক্তারের মতো দেশের অসংখ্য যুবক ও যুবতী স্বাবলম্বী হচ্ছেন, অবদান রাখছেন জীবনমান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
বরিশাল সদরের বাসিন্দা ফাতেমা আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখায় গত বছর জাতীয় যুব পুরস্কার পান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ থেকেই আমার শুরু। ওই প্রশিক্ষণ পেয়েই আমি একটি প্রতিষ্ঠান দিই।’ তিনি জানান, তাঁর কাছ প্রশিক্ষণ নিয়ে অসংখ্য নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে স্বল্প পুঁজি ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এখন অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে পিছিয়ে পড়ছেন।
আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক যুব দিবস। এবারের আন্তর্জাতিক যুব দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তর: ধরিত্রী ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য তরুণদের উদ্ভাবন’। বাংলাদেশও যুব উদ্যোক্তাদের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং পরিবেশের জন্য উপকারী সব উদ্যোগকে উৎসাহ দিচ্ছে। বৃক্ষরোপণ, মাছ চাষ, গরু-মুরগি পালন, মৌসুমি ফল ও সবজি চাষ—একই সঙ্গে যা ধরিত্রী ও মানুষের জন্য উপকারী, এমন তরুণ উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। গত বছর ২১ জন যুবক-যুবতীকে ‘সফল আত্মকর্মী’ হিসেবে জাতীয় যুব পুরস্কার ২০২০ দেওয়া হয়। এই ২১ জনের মধ্যে ১৪ জনই মাছ চাষ, কোয়েল-মুরগি-গরু পালন, মাল্টা-পেঁপেসহ চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা একই সঙ্গে অন্যদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছেন এবং খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখছেন।
তেমনই একজন বান্দরবান সদর উপজেলার রেইছাথালিপাড়া গ্রামের মা সিং নু মারমা। আর্থিক টানাপোড়েনে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ হয় তাঁর। দুই বোনের মধ্যে বড় সন্তান মা সিং নু। পরিবারের হাল এ কারণে তাঁকেই ধরতে হয়। তিনি ২০১৬ সালে বান্দরবানের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে উন্নত প্রযুক্তিতে চাষাবাদের প্রশিক্ষণ থেকে। অধিদপ্তর থেকে ঋণও নেন।
মা সিং নু এখন এক একর জমিতে কলাবাগান, পেয়ারা, পেঁপে, ঘাসসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেন। পাশাপাশি পালন করেন গরু, মুরগি ও শূকর। তাঁর বার্ষিক আয় এখন ১০ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমার বাগানে এখন ১৩ জন কাজ করেন। ১০ বছর আগেও আমাদের টানাটানির সংসার ছিল। এখন আমরা ভালো আছি। মেয়ে বলে যারা প্রথমে আমাকে অবজ্ঞা করত, তারাই এখন আমার প্রশংসা করে।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে যুবকদের এগিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি এসেছে। জেলা পর্যায়ে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৯টি কোর্সে আবাসিক প্রশিক্ষণ এবং ৩০টি কোর্সের অনাবাসিক প্রশিক্ষণ চলছে অনলাইনে। এ বছরের মে মাস থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ স্থগিত আছে।
জেলা পর্যায়ের বেশির ভাগ প্রশিক্ষক অনলাইনের প্রশিক্ষণে ফাঁকি দেন বলে জানান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়। পরে আবার কিছুদিন চালু ছিল। এ বছরের মে মাস থেকে প্রশিক্ষণ অনলাইনেই দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে জেলা পর্যায়ে সব প্রশিক্ষক সক্রিয় নন। করোনার কারণে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর গত বছর বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ে। এ বছরের চিত্রও একই।
জানতে চাইলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজহারুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে সারা দেশে প্রশিক্ষণ বন্ধ আছে। গতকাল বুধবার থেকে আবার তা শুরু হয়েছে। সব কোর্সের প্রশিক্ষণগুলো অনলাইনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে একটু প্রতিবন্ধকতা হয়েছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন গত বছর মোটামুটি ছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে তাঁর আশা।
কর্মসংস্থান হয় এক-তৃতীয়াংশের
১৯৮১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যাত্রা শুরু। প্রতিবছর লাখো বেকার যুবক এখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তবে প্রশিক্ষণ পাওয়া যুবকদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের পরে আত্মকর্মসংস্থান হয়। আর বর্তমান সরকারের আমলে প্রশিক্ষণ পাওয়া এক–চতুর্থাংশের আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের হিসাবে, শুরু থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত অধিদপ্তর থেকে ৬৪ লাখ ৬১ হাজার ২৩৮ বেকার যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার ১৫৩ জনের। আর বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩৩ লাখ ১৪ হাজার ১৫৯ জন বেকার যুবক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৭০৫ জনের।
এ বিষয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষিত যুবাদের আত্মকর্মসংস্থান না হওয়ার এ ঘাটতি আমরা পূরণ করার চেষ্টা করছি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যাতে যুবারা হারিয়ে না যায়, সে জন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পর উৎপাদনের পণ্য বাজারজাত করাসহ উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক যুব দিবস ঘোষণা করে। বাংলাদেশ প্রতিবছর বিভিন্ন কার্যক্রমে দিবসটি পালন করে থাকে। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবারের যুব দিবসের কার্যক্রম ভার্চ্যুয়ালি করবে জাতিসংঘ। বাংলাদেশও এবারের দিবসটি পালন করবে ভার্চ্যুয়ালি। আজ সকালে যুব দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর।
করোনার সংক্রমণ বাড়ার কারণে এবারের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত আকারে করা হচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি গাছের চারা বিতরণ, ঋণ বিতরণের কর্মসূচিও পালন করবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর।