সাংবাদিক হাবীবুর রহমানের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর তদন্তের দাবি
সময়ের আলো পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাবীবুর রহমানের মৃত্যুকে ‘রহস্যজনক’ আখ্যা দিয়ে এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন তাঁর শিক্ষক, বন্ধু, অগ্রজ-অনুজ ও ছাত্রনেতারা৷ প্রয়াত এই সাংবাদিকের পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণাও দিয়েছেন তাঁরা।
১৮ জানুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হাবীবুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে ধারণা করলেও হাবীবুর রহমানের এই মৃত্যুকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা। হাবীবুরের স্মরণসভায় সেই প্রশ্নই আবারও উঠে এল সবার কণ্ঠে।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে হাবীবুর রহমানের স্মরণসভা হয়। হাবীবুর রহমান ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। হাবীবুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। স্মরণসভায় তাঁর বিভাগের শিক্ষক, বিভিন্ন পেশায় কর্মরত বন্ধু, সাংবাদিক সংগঠনের নেতা, অগ্রজ-অনুজদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারাও স্মরণসভা বক্তব্য দেন।
হাবীবুর রহমানের চলে যাওয়া ‘অনেকটা রহস্যমিশ্রিত’ বলে মন্তব্য করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক কাবেরী গায়েন। তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থীর স্মরণসভায় আসতে হবে, তা কখনো ভাবিনি।
বাবার কাছে সন্তানের কফিন যেমন ভারী, তেমনি একজন শিক্ষকের কাছে সন্তানের কফিনও খুব ভারী। হাবীবুর রহমানের মৃত্যুর খবরটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। হাবীবুর খুব মৃদুভাষী ছিল। তার মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। এসবেরও তদন্ত প্রয়োজন। হাবীবুরের পরিবারকে সহযোগিতার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা পাশে থাকব।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল মনসুর আহাম্মদ বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর জন্য স্মৃতিচারণা করাটা খুবই কষ্টের। হাবীবুর রহমানকে আমি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছি। সে বরাবরই বিনয়ী ছিল, তাঁর মানবিক গুণাবলি ছিল অনন্য। তাঁর হাসিমুখ সবাইকে মুগ্ধ করত। হাবীবের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। আমাদের বিভাগের সবার পক্ষ থেকে আমি হাবীবুরের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। বিভাগ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁর পরিবারের পাশে থেকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।’
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘হাবীবুর রহমানের সঙ্গে আমার সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা হলে ভিন্ন ধরনের আলামত থাকার কথা। আমি চাই, এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক। তদন্তের মাধ্যমে একটি ফলাফল বেরিয়ে আসুক। তাহলে আমরা শান্তি পাব। আমাদের সবার তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
ডিআরইউর সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাবীবুর রহমান একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ছিলেন। এই তরুণ আমার খুব কাছের বন্ধু ও ছোট ভাই ছিলেন। তিনি আমার ও তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন। হাবীবুর রহমান যেভাবে নিহত হয়েছেন, এ ধরনের আর কোনো ঘটনা ঘটুক, তা আমরা চাই না। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে মনে হয়েছে। তবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ আমরা জানতে চাই। তাই আমরা ডিআরইউর পক্ষ থেকে এ ঘটনার পূর্ণ তদন্ত চেয়েছি। আশা করি, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।’
হাবীবুর রহমানের মৃত্যুতে দেশের ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব শাখাওয়াত মুন। তিনি বলেন, ‘হাবীবুর রহমানের স্মরণসভায় আসাটা খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের। তাঁর চলে যাওয়ায় দেশের যেমন ক্ষতি হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তাঁর পরিবারের। আমরা সবাই তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করব। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ একটি পরিবার। এই পরিবারের সদস্যদের বিচ্যুতিতে আমরা কষ্ট পাই’
হাবীবুর রহমানের বন্ধু ডিএমপির বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তয়াছির জাহান বলেন, ‘হাবীবুর রহমান আমার বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের প্রথম দিকের বন্ধু। খুব মন খারাপ হলে যে অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম, হাবীবুর তাঁদের একজন। তীব্র আনন্দ হলেও পরিবারের বাইরে যে দু-একজনের সঙ্গে কথা বলতাম, সে তাঁদেরও একজন। হাবীবুর রহমানের মৃত্যুতে আমার সারাটা জীবন খুব অস্থিরতা আর মন খারাপে কাটবে।
একজন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক হিসেবে হাবীবুর রহমান স্বাধীনতার পক্ষে সাংবাদিকতা পেশাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে মন্তব্য করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের হাবীব ভাই বেঁচে থাকবেন আমাদের ভালোবাসায়। তাঁর পরিবারের পাশে আমরা আছি। হাবীবুর রহমানের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর আসা কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখে অসংগতি আছে বলে মনে হয়েছে। যা-ই ঘটে থাকুক, তদন্ত হোক।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘হাবীবুর রহমান আমাদের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই৷ তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সংগঠন থেকে সাবেক হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে দেশরত্ন শেখ হাসিনার মিশন-ভিশন বাস্তবায়নে সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। তিনি একজন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক ছিলেন। হাবীবুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার পাব বলে আমরা আশা করি। তাঁর পরিবারের জন্য আমরা কিছু করতে পারব বলে আশা করি।
হাবীবুর রহমানের সাংবাদিক সমাজকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল বলে মন্তব্য করেন এনটিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মিজান রহমান। ডিআরইউর সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাদিয়া শারমিন বলেন, এই সাংগঠনিক মানুষটির পক্ষে দেশ ও জাতিকে যা দেওয়ার সুযোগ ছিল, তা শেষ হয়ে গেল। এই নেই হওয়াটা কষ্ট ও হতাশার। আমরা সব সময় হাবীবুর রহমানের পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করব।
হাবীবুর রহমানের বন্ধু ও নিউ এজ পত্রিকার সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ বলেন, হাবীবুরের মৃত্যুর ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা মানতে আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা ঠিক সায় দেয় না। একটাই আহ্বান, আসলে কী ঘটেছে, তা যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে বের করে। হাবীবুরের মৃত্যুতে একজন প্রতিশ্রুতিশীল পেশাদার ব্যক্তিকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
স্মরণসভায় অন্যদের মধ্যে যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাকিল হাসান ও মনিরুল ইসলাম, দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি হাসান নিটোল, বর্তমান সভাপতি মেহেদী হাসান, হাবীবুর রহমানের বন্ধু শাহিনুল ইসলাম ও ফারাবি হাফিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন, বর্তমান সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন৷ স্মরণসভায় হাবীবুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।