সাংসদদের জন্য আবার নির্বাচনী প্রকল্প
জাতীয় নির্বাচনের আগের বছরে জনতুষ্টির বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রকল্পের পর এবার প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকায় নলকূপ ও পাবলিক টয়লেট (গণশৌচাগার) নির্মাণের জন্য গড়ে তিন কোটি টাকা পাবেন। আগামী দুই বছরে এই টাকা খরচ করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রায় ৯০৩ কোটি টাকার ‘বাংলাদেশের ৩০০টি নির্বাচনী আসনে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের বিশেষ প্রকল্প’ প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। পুরো টাকা সরকার নিজস্ব উৎস থেকে দেবে। গত মাসে এই প্রকল্প প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের জন্য উঠছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাংসদেরা নিজের নির্বাচনী এলাকায় কোথায় কোথায় নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণ করতে হবে, তা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানিয়ে দেবেন। ওই অধিদপ্তর সাংসদদের চাহিদামতো নলকূপ ও টয়লেট তৈরি করবে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটি পুরোপুরি একটি নির্বাচনী প্রকল্প। নির্বাচনে সাংসদদের সহায়তা করা ছাড়া এই প্রকল্প নেওয়ার আর কোনো কারণ দেখি না। এই প্রকল্পের যৌক্তিকতাও নেই। কারণ, চাহিদামতো নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
সরকার এর আগেও এ ধরনের প্রকল্প নিয়েছে। আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে নিজের এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য প্রত্যেক সাংসদ বরাদ্দ পেয়েছেন। ২০১০ সালে ৪ হাজার ৬৯১ কোটি টাকার ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পে পরের পাঁচ বছরে ২৭৯ জন সাংসদ ১৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রতিবছর গড়ে তিন কোটি টাকা পান তাঁরা। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেলে এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ ধরা হয় চার বছর। দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হবে ২০১৯ সালের জুন মাসে। দ্বিতীয় দফায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য সাংসদেরা বছরে বরাদ্দ পাচ্ছেন পাঁচ কোটি টাকা করে। প্রত্যেকেই চার বছরে মোট পাবেন ২০ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণের প্রকল্পে মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত। ইতিমধ্যে প্রায় এক বছর পার হয়ে গেছে। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্প পাস হলে আগামী দুই বছরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৯২টি গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে।
তবে অগভীর নলকূপে আর্সেনিকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাভেদে অগভীর নলকূপে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় অগভীর নলকূপে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। আবার পায়খানার কাছাকাছি
অগভীর নলকূপ বসানো হলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব বিবেচনা করে অগভীর নলকূপ বসানো উচিত। তিনি মনে করেন, এলাকাভেদে মাটির নিচে পানির স্তর কোথায় কত, তা হিসাব-নিকাশ করে গভীর ও অগভীর নলকূপ বসানোর স্থান ঠিক করা দরকার।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকায় গড়ে সাড়ে চার শয়ের মতো নলকূপ স্থাপনের সুযোগ পাবেন। যেহেতু নলকূপগুলো ওয়াসাভুক্ত এলাকার বাইরে স্থাপন করতে হবে, তাই অনেক সাংসদ আরও বেশি নলকূপ বরাদ্দ পেতে পারেন। নলকূপভেদে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক সাংসদ নিজের এলাকায় একটি করে পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগার নির্মাণের সুযোগ পাবেন। প্রতিটি টয়লেট নির্মাণের খরচ ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য মোট ৪ হাজার ৭১৯টি আধার বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং নির্মাণ করা হবে।
বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি—সবই আছে
অন্যান্য প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পে গাড়িও কেনা হবে। একটি জিপ ও দুটি পিকআপ কিনতে খরচ হবে প্রায় দুই কোটি টাকা। এর মধ্যে একটি জিপের জন্য বরাদ্দ ৯০ লাখ টাকা। সাধারণত ৯০ লাখ টাকার জিপ বেশ বিলাসবহুল হয়। আবার প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণের সুযোগও রাখা হয়েছে। নলকূপ স্থাপন ও টয়লেট নির্মাণে বিদেশ থেকে অভিজ্ঞতা লাভের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সরবরাহ, সেবাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ আরও প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার সুযোগও তৈরি করা হয়েছে। ৯৬০টি প্যাকেজে কাজ ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মানে, ৯৬০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে কাজ দেওয়া হবে। জানা গেছে, প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় নলকূপ স্থাপন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার আধার নির্মাণ এবং টয়লেট নির্মাণের জন্য আলাদা আলাদা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, নলকূপ বসানোর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশে যাওয়া একদমই অপ্রয়োজনীয়। এটি সরকারি কর্মকর্তাদের বোনাস দেওয়ার মতো। তাঁর মতে, একটি প্রকল্পে এতগুলো প্যাকেজে ঠিকাদারি দেওয়ার কোনো দরকার নেই। ছোট ছোট ভাগে কাজ দিলে স্থানীয় প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা বেশি মুনাফার চেষ্টা করবেন। এতে কাজের মান খারাপ হবে। একটি উপজেলায় বড়জোর একজন ঠিকাদার নিয়োগ করা যেতে পারে।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। কেন এই প্রকল্প নেওয়া হলো, এ প্রসঙ্গে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাংসদেরা নিজেদের এলাকার জন্য নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র দেন। কিন্তু রাজস্ব বাজেটের কর্মসূচির আওতায় এর সামান্যই পূরণ করা সম্ভব হয়। অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) এ কে এম ইব্রাহিম প্রথম আলোকে জানান, এই প্রকল্পের আওতায় নলকূপ ও প্রাকৃতিক পানি সংরক্ষণ করে জনগণের জন্য সুপেয় পানির উৎস তৈরি করা হবে। এ ধরনের নলকূপ স্থাপনের ব্যাপক চাহিদা আছে। তাই সাংসদদের চাহিদামতো নলকূপ স্থাপন করা হলেও একই ধরনের অন্য প্রকল্পের সঙ্গে ‘রিপিট’ হওয়ার সুযোগ নেই।
তবে এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইদানীং স্থানীয় পর্যায়ে যত সম্পদ যাচ্ছে, এর বেশির ভাগই সাংসদদের মাধ্যমে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে সাংসদদের ইচ্ছামতো প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। অথচ স্থানীয় সরকার প্রশাসনে সাংসদদের কোনো কাঠামো নেই। তাঁরা মূলত আইনপ্রণেতা।