উদ্যোগ
সাতরং–এ পৃথিবী বদলের স্লোগান
শিশুদের নিয়ে বগুড়ায় গড়ে উঠেছে চিত্রকর্ম শেখার পাঠশালা সাতরং। এর অর্ধেক শিক্ষার্থীই সুবিধাবঞ্চিত। বেশ কয়েকজনের আঁকা চিত্রকর্ম পুরস্কার পেয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়ক ও জলেশ্বরীতলা এলাকায় রঙের পাঠশালা সাতরং–এর রয়েছে দুটি ক্যাম্পাস। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে সাফল্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে রঙের পাঠশালা ‘সাতরং’। এখানে শিশু-কিশোরদের চিত্রশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পাঠশালার খুদে চিত্রশিল্পীদের কেউ এরই মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার, স্বীকৃতি, সম্মাননা পেয়েছে।
সাতরং পাঠশালার যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। ‘সব শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বদলে দিব এই পৃথিবী’ স্লোগানে সাতরং প্রতিষ্ঠা করেন বগুড়ার চিত্রশিল্পী চন্দন কুমার রায়। তাঁর সঙ্গে এ পাঠশালায় রং-তুলির আঁচড়ের কর্মযজ্ঞে যোগ দিয়েছেন আর্ট কলেজ থেকে পাস করা একদল তরুণ। এ পাঠশালার শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত। বিনা মূল্যে চিত্রকর্মে দক্ষ করে গড়ে তোলা ছাড়াও তাদের রং, তুলি, পেনসিল, খাতা বিনা মূল্যে সরবরাহ করে সাতরং।
পাঠশালার শিক্ষার্থী সোয়েব মাহমুদ এ বছর নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন ও গ্লোবাল নমিনি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ১৬ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বেসিস মিলনায়তনে এ অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। এ ছাড়া শেখ রাসেল দিবসে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম ও জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে পাঠশালার শিক্ষার্থী মৌমিতা ভৌমিক।
বিশ্বে সাতরং
সাতরং আর্ট স্কুলের খুদে চিত্রশিল্পীদের মধ্যে দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার জিতেছে বেশ কজন। জাপানে আয়োজিত টয়োটা ড্রিম কার আর্ট কমপিটিশনে স্বপ্নের গাড়ি প্রতিযোগিতায় ২০১১ সালে ‘ক’ বিভাগে প্রথম হয় সাদিয়া মুস্তারিন। পরে আয়োজকদের আমন্ত্রণে জাপান সফর করে এই খুদে শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ২০১২ সালে একই প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে দ্বিতীয় হয়ে জাপান ঘুরে আসে ইরাম মাহবুব। একই বছর প্রতিযোগিতার ‘গ’ বিভাগে চতুর্থ পুরস্কার জেতে আইহাম মোরশেদ হায়দার, ‘খ’ বিভাগে প্রথম হয় আনিকা নোশীন, ২০১৩ সালে ‘ক’ বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার পায় মাইশা মাহফুজ, ২০১১ সালে ‘খ’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পায় মোহাইমিন কবির।
সাতরং পাঠশালার উদ্যোক্তা চন্দন কুমার রায় বলেন, একাধিক শিক্ষার্থী বিশ্বখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী জাপানি প্রতিষ্ঠান টয়োটার ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছে। টয়োটার আমন্ত্রণে তারা জাপানও ঘুরে এসেছে। এর মধ্যে একজনের আঁকা পরিবেশবান্ধব গাড়ির ছবি আয়োজকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
যাত্রা শুরু
সাতরং-এর উদ্যোক্তা চন্দন কুমার রায় জানান, ২০০০ সালের দিকে আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর বগুড়া শহরে প্রথমে চিত্রকর্মের একটা ব্যবসা শুরু করেন। নাম ছিল সাতরং। অল্প দিনেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শিল্পকলা একাডেমি ও গণসাক্ষরতা অভিযান নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় চিত্রকর্ম প্রশিক্ষকের কাজ করেন। প্রথম আলো বন্ধুসভা করতে গিয়ে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজের বিষয়টি মাথায় আসে। সিদ্ধান্ত নেন, ব্যানার লেখার ব্যবসা বাদ দিয়ে শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি চিত্রকলার পাঠশালা খুলবেন। তবে এটি কোনো গতানুগতিক পাঠশালা হবে না, শিক্ষার্থীরা অন্য বিদ্যালয়েই পড়বে। পাশাপাশি চিত্রকর্ম শিখবে এখানে। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৩ সালে শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কে নিজ বাসায় যাত্রা শুরু সাতরং আর্ট স্কুলের। শুরুতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে এই পাঠশালা যাত্রা শুরু করলেও পরে খরচ জোগাতে অন্য শিশুদেরও ভর্তি করা হয়।
পাঠশালায় একদিন
বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়ার গলি ধরে একটু এগোনোর পর দেখা মেলে সাতরং–এর সামনে ৪০ থেকে ৫০ জন অভিভাবকের জটলা। পাঠশালার ভেতরে ধীর লয়ে বাজছে ইন্দ্রাণী সেনের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো...’। একটি হলরুমের আদলে বড় কক্ষে জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী ছবি আঁকায় মগ্ন। চার দেয়ালজুড়ে টানানো হয় শিক্ষার্থীদের আঁকা চিত্রকর্ম।
পাঠশালায় আসা শিক্ষার্থীদের কেউ পেনসিল, জলরঙে, কেউ আবার তেল ও অ্যাক্রিলিক রঙে ছবি আঁকছে। ধানখেতের বুক চিরে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নদী, পাড়ে গরু চরানো রাখালের বাঁশির ছবি, কেউ আঁকছে জীববৈচিত্র্য। পাঠশালার ছয়জন শিক্ষক হাতে–কলমে শিক্ষার্থীদের চিত্রকর্ম শেখাচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার চন্দন কুমার বলেন, সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় প্রতিদিন চার শিফটে ২০০ শিক্ষার্থীকে অঙ্কন শেখানো হয়। ছবি আঁকা ছাড়াও শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যস্ত রাখা হয় নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয়ে।