সার্চ কমিটি গঠনের আগেই বিতর্ক

ইসি গঠনে আইন না থাকায় সরকার পছন্দ অনুযায়ী সার্চ কমিটি এবং কমিশন গঠনের সুযোগ পায়।

  • বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি।

  • জানুয়ারিতে হতে পারে সার্চ কমিটি।

  • সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন শুরু ২০১২ সালে।

নির্বাচন কমিশন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) কীভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। সংবিধানের আলোকে ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ পরবর্তী ইসি গঠনের জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষে আহ্বান জানানো হলেও সরকার বলছে, এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নতুন কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতে যে সার্চ কমিটি করা হবে, সেটি নিরপেক্ষ হবে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

চার মাস পর, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধানে একটি আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের নির্দেশনা আছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে এই আইন হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অনেকে মনে করছেন, এখনো যে সময় আছে, তাতে একটি আইন করা সম্ভব। কারণ, এই আইনের একটি খসড়া করা আছে। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন এই খসড়া করেছিল।

তবে সরকার জানিয়েছে, করোনা মহামারি ও সময়স্বল্পতার কারণে এবারও আইনটি করা যাচ্ছে না। সার্চ কমিটির (অনুসন্ধান কমিটি) মাধ্যমেই কমিশন গঠন করা হবে। আগামী জানুয়ারিতে এই কমিটি গঠন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

আইন না হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নিয়োগ দেন। তবে ২০১২ সালে ইসি গঠনের আগে সার্চ কমিটি গঠনের প্রথা চালু হয়। সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল সার্চ কমিটির মাধ্যমে। দুটি কমিশনই ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছে।

ইসি গঠনে আইন না থাকায় সরকার নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সার্চ কমিটি এবং কমিশন গঠনের সুযোগ পায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। কারণ, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্য সব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়।

ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বলছে, তারা সার্চ কমিটি নিয়ে কিছু ভাবছে না। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কিসের সার্চ কমিটি? আপনারা যাকে চাইবেন, সে-ই হবে।’

এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
অতীতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশন কেমন হয়েছে, তা সবাই দেখেছে।
এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন করে হোক আর সার্চ কমিটি করে হোক, এই সরকারের অধীনে যা-ই হবে, তা-ই তামাশা। বিএনপি এতে অংশ নিতে রাজি নয়।’

সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের রীতি শুরু হয়েছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সময়। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠনের আগে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সদস্য হিসেবে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, তৎকালীন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের আগেও ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ২০১৭ সালের ওই কমিটিরও প্রধান ছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। কমিটির সদস্য ছিলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন সিএজি মাসুদ আহমেদ, পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতার। গতবার সার্চ কমিটি গঠনের পরও কমিটির সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিএনপি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি কখনো গঠনমূলক রাজনীতি করে না। তারা ক্ষমতায় থাকতে নিজেদের ইচ্ছেমতো ইসি গঠন করেছিল, এ কারণে তাদের মাথায় দলীয়করণের চিন্তা ঘুরপাক খায়। তিনি বলেন, তাঁরাও ইসি গঠনে আইন করতে চান। কিন্তু সময়স্বল্পতার কারণে আগামী কমিশন গঠনের আগে আইনটি করা সম্ভব হবে না।

অবশ্য বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে আরও চার মাস। সরকার চাইলে এ সময়ের মধ্যে একটি আইন করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করেছিল জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দাবি, সংবিধানে যেভাবে বলা আছে, সেভাবে একটি আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক। নতুন কমিশন গঠন করার আগে এই আইন করার মতো সময় এখনো আছে। সরকার আন্তরিক হলে আইন করা সম্ভব।

সার্চ কমিটির কার্যপরিধি কেমন হবে, তা সুনির্দিষ্ট নয়। তবে এর আগে দেখা গেছে, কমিটি সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য বেশ কিছু নাম প্রস্তাব করেন। নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন গঠনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সেখানে দলগুলো পাঁচটি করে নাম প্রস্তাব করেছিল। ওই নামগুলো বিবেচনায় নিয়ে সার্চ কমিটি মোট ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেছিল। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন গঠন করেন। তবে কার কার নাম কমিটি সুপারিশ করেছিল, তা প্রকাশ করা হয়নি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দল এর আগেও নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁরা এখনো মনে করেন, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ মুহূর্তে আইন করা সম্ভব না হলে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সার্চ কমিটিকে সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মতামত নিতে হবে। সার্চ কমিটি সম্ভাব্য কমিশনারদের যে সংক্ষিপ্ত তালিকা করবে, তা প্রকাশ করে গণশুনানির ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৭ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। এই কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, অনিয়মসহ ৯টি অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তাঁরা এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি দেন রাষ্ট্রপতিকে। এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে সংবিধানের আলোকে আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে নতুন নির্বাচন কমিশনের দাবি জানান। তাঁরা বলেন, বর্তমান ও এর আগের নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষের আস্থা ফেরাতে নির্বাচন কমিশন এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন না থাকায় সরকার যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে নিয়োগ দিতে পারে। এখনো চার মাস সময় আছে, সরকার চাইলে আইন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘অতীতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশন কেমন হয়েছে, তা সবাই দেখেছে।’