সেই স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচির সুফল কতটা পাওয়া গেল...
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি চালু করেছিল সরকার। মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, উপকারভোগীদের তালিকায় প্রায় অর্ধেকই দরিদ্র নন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) নামে ওই বিমা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ত্রুটি ছিল। ভালো হলেও কর্মসূচির পুরোপুরি সুফল পাওয়া যায়নি।
ইউএসএআইডির অর্থায়নে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি দল কর্মসূচির আওতাভুক্ত তিনটি উপজেলা এবং কর্মসূচির বাইরের তিনটি উপজেলার ওপর গবেষণা চালায়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের কাছে তারা ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
ওই দলের একজন সদস্য মাহবুবে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসূচিটি ভালো ছিল। কিন্তু এর বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে ত্রুটি ছিল। ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা করলে এর সুফল পেত সবাই।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট চেষ্টা করে আসছিল। গবেষণায় তারা দেখেছে, ২০১২ সালে একজন ব্যক্তিকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৩ শতাংশ বহন করতে হতো, ২০১৫ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশে। পকেট থেকে যেন বেশি টাকা বেরিয়ে না যায়, সে জন্য স্বাস্থ্যবিমার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সূত্রগুলো বলছে, এ কাজে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সঙ্গে অধিদপ্তরের সমন্বয়ের অভাব আছে। এতে এসএসকের বাস্তবায়ন হয়নি ঠিকঠাক। মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) মো. নুরুল আমিন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, এসএসকে কর্মসূচিতে থাকা ত্রুটিগুলো সংশোধন করে এটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের বাকি সব উপজেলা ও ঢাকার কয়েকটি ওয়ার্ডে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
এই কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এবার নিজেই উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই–বাছাই করেছে। তবে তাঁর দাবি, যে তালিকার ভিত্তিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ব্যক্তিদের নাম ঠিক করা হয়েছিল, সেটি প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো। এর মধ্যে অনেকেরই আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে থাকতে পারে।
কী হওয়ার কথা ছিল, কী হলো
কাগজপত্রে দেখা গেছে, এসএসকে নামে কর্মসূচিটি শুরু হয় ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায়। পরে এই কর্মসূচিতে মধুপুর ও ঘাটাইলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিমা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবা পেতে দরিদ্র মানুষের যে আর্থিক কষ্ট তা কমিয়ে আনা, হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বাড়ানো। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত এ খাতে ২২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
কথা ছিল, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লোকজনের চিকিৎসায় সরকার প্রতি মাসে এক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দেবে। বছরে কার্ডপ্রতি সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকবে ৫০ হাজার টাকা। এসএসকের সুবিধাভোগী ব্যক্তি কার্ড নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবেন। উপজেলায় চিকিৎসা না হলে রোগীদের পাঠানো হবে টাঙ্গাইল জেলা হাসপাতালে। রোগী শুধু চিকিৎসাই পাবেন না, তিনি রোগ নির্ণয় পরীক্ষা ও ওষুধও পাবেন। ৭৮ ধরনের রোগে এ সুবিধা পাবেন হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা।
কর্মসূচির আওতায় তিন উপজেলার ৯০টি গ্রামের দিনমজুর, ভিটে ছাড়া কিছু নেই এবং আয়ের নির্দিষ্ট উৎস নেই—এমন লোকজনের অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মূল্যায়নকারী দল সরেজমিনে তিনটি উপজেলা ঘুরে ২০টি গ্রাম খুঁজেই পায়নি।
অবশিষ্ট ৭০ গ্রামের ৪২ শতাংশ কার্ডধারী দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠী নন বলেও প্রমাণ পায় তারা। খোঁজখবর নিয়ে দলটি জানতে পারে, শর্ত অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করে উপকারভোগীর তালিকা চূড়ান্ত করা ও ছবি তোলার কথা। পুরো কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধির।
সাক্ষাৎকারে এসএসকে কার্ডধারী ব্যক্তিরা বলেন, যাঁরা কার্ড চান, তাঁরা যেন স্থানীয় মেম্বরের বাসায় যান—এমন খবর পেয়ে তাঁরা কার্ড নিতে যান। অনেকেই আবার কার্ড করেও সেবা নেননি বা নিতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে একজন বলেছেন, তাঁর জায়গায় এসএসকে কার্ডে আরেকজনের ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে তিনি কখনোই আর ওই কার্ড ব্যবহার করতে পারেননি।
সমস্যার কথা বললেও সমাধান হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। ডেটাবেইস তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট সময় পর আর সেবা দেয়নি। তাদের ওই ডেটাবেইসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঢোকার সুযোগও ছিল না।
কার্ডধারী ব্যক্তিরা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এত দূরে যে সেখানে যাওয়ার চেয়ে টাঙ্গাইলে চলে যাওয়া সহজ। অনেকে স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের দুর্ব্যবহারের কথা বলেছেন। ছুটির দিনে এসএসকে বুথ বন্ধ থাকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাব ছিল কোথাও কোথাও। তিনটি উপজেলা হাসপাতালের কোনোটিতেই সব ধরনের রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি অসুস্থ রোগীদের শয্যার কাছে এসে নমুনা নেওয়া যায়নি।
একজন কার্ডধারী বলেছেন, রোগের বাড়াবাড়ি হলে অ্যাম্বুলেন্সে করে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বারবার বলে দিয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্সচালককে যেন কোনো টাকা দেওয়া না হয়। কিন্তু টাকা না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে কেউ অ্যাম্বুলেন্সে তোলেনি।
চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকেও অভিযোগ ছিল বিস্তর। একজন ব্যবস্থাপক বলেন, ইচ্ছা করেই কাউকে কাউকে ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে। যেমন স্থানীয় লোকজনের অনেকে চেয়ারম্যানের সহায়তায় কার্ড পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করেন না। তাঁরা কার্ড নিয়ে হাসপাতালে আসেন, ডাক্তারদের ধমক দেন।
এসএসকের আওতায় যে ৭৮টি রোগের চিকিৎসা পাওয়ার কথা, তার বাইরের রোগের চিকিৎসা দাবি করেন। আবার এও দেখা গেছে, কেউ কেউ দুটি রোগ নিয়ে এসেছেন। কারও হয়তো ডায়াবেটিস ও ফুড আলসার—দুই–ই আছে, কিন্তু এসএসকেতে শুধু ডায়াবেটিসের চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে এসএসকে কার্ডের আওতায় রোগী কী সুবিধা পাবেন, তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়।
এসএসকে কার্ডধারীদের চিকিৎসা, ওষুধ ও রোগ নির্ণয়ের খরচে হিসাব আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হয়। হাসপাতালের জনবল না বাড়িয়ে যাঁরা আছেন, তাঁদেরই হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছিল। এ কারণে সময় লাগছিল বেশি। এর অনুমোদন আবার চূড়ান্ত করেন জনপ্রতিনিধি। তাঁকে সব সময় পাওয়া যায়নি। বিমার টাকা হাসপাতালে পৌঁছাতে কখনো কখনো ছয় মাসও লেগে গেছে।
আইসিডিআরবির মূল্যায়নকারী দলের সদস্য মাহবুবে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কালিহাতী, ঘাটাইল ও মধুপুরের কার্ডধারীদের সঙ্গে বাসাইল, সখীপুর ও গোপালপুরের বাসিন্দাদের একটি তুলনা করেছেন। যাঁরা কার্ড ব্যবহার করেছেন, তাঁদের খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।
মাহবুবে এলাহী আরও বলেন, অনেকে কার্ড পেয়েও ব্যবহার করেননি। কারণ, এই সেবা শুধু ভর্তি রোগীদের জন্য প্রযোজ্য। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দূর থেকে হয়তো একজন হাসপাতালে গিয়েছেন, তাঁকে দেখে চিকিৎসক ভর্তি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন আর তিনি এসএসকের কোনো সুবিধা পাননি। এ কারণে তাঁর সময় ও অর্থ—দুই–ই নষ্ট হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১০টি পদ আছে, সেখানে এক–দুজনের বেশি পাওয়া যায়নি কখনোই। আবার অনেকে জানতেন না এই কার্ড কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। উপকারভোগীকে ঠিকমতো বোঝানোর কাজটি করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) মো. নুরুল আমিন বলেছেন, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এবার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসএসকে কার্ড দিয়ে রোগী যেন বেসরকারি ক্লিনিকেও সেবা নিতে পারেন, সে বিষয়ও নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন তাঁরা। একজন রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ডিজিটাল মাধ্যমে রেকর্ড থাকে, তাও নিশ্চিত করা হবে। তাঁরা এই কর্মসূচি যে করেই হোক সফল করতে চান।