ভাষার মাসে আমরা শুনব জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনের ঘটনা। আজ পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর
![.](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2016%2F02%2F05%2Fc67253b0db1c80771823b116faad54ce-25.jpg?auto=format%2Ccompress)
বাম রাজনীতি, কৃষক রাজনীতির অন্যতম ঘাঁটি পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর, আপন কর্মে তাদের খ্যাতি। বিভাগপূর্বকাল থেকে এ দুই অঞ্চল পূর্বোক্ত রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি। এ অঞ্চলে, বিশেষ করে বামধারায় প্রভাবিত কৃষক আন্দোলনের ভিত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সে সময় ডা. আবদুল কাদের চৌধুরীর অবদান প্রবাদপ্রতিম। বিভাগ-উত্তর সময়ে পাঁচবিবির নাম বারবার রাজনীতিতে উঠে আসে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কল্যাণে।
পাঁচবিবি-আক্কেলপুর এলাকায় ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর আক্কেলপুর নিবাসী, বগুড়া আজিজুল হক কলেজের জ্যেষ্ঠ ছাত্র কবি আতাউর রহমান। তিনি প্রগতিশীল বাম রাজনীতিরও সক্রিয় সদস্য। তাঁর ও অন্য সহযোগীদের চেষ্টায় এই এলাকার বিভিন্ন স্তরের ছাত্ররা আন্দোলন সফল করে তুলতে সংগঠিত হয়। এতে যুবলীগের ছিল বিশেষ ভূমিকা। আতাউর রহমান ছিলেন বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি।
বগুড়াকেন্দ্রিক রাজনীতি পাঁচবিবি-আক্কেলপুরের রাজনৈতিক তৎপরতা প্রভাবিত করলেও এদের নিজস্ব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। স্থানীয় সূত্রে সুজন হাজারী লিখেছেন: ‘বামপন্থী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রসর কমিউনিস্টদের শক্ত ঘাঁটি নামে পরিচিত পাঁচবিবি এবং আক্কেলপুরের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাঁচবিবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।’ স্থানীয় বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
যেমন কমিউনিস্ট নেতা নজিরউদ্দীন মণ্ডল, কামালউদ্দীন মণ্ডল, নেপথ্যে ডা. আবদুল কাদের চৌধুরীসহ একাধিক বাম বা গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনীতিমনস্ক মানুষ পাঁচবিবিতে ভাষা আন্দোলন শক্তিশালী করে তুলতে এগিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন শুকুর আলী মণ্ডল, মেছের আলী, অধীরচন্দ্র সাহা, অরবিন্দ কুণ্ডু, মনসুর আলী ফকির, নঈমউদ্দীন মোল্লা, রকিব মাস্টার, মনিরউদ্দিন প্রমুখ।
পাঁচবিবির ভাষা আন্দোলনে লালবিহারী হাইস্কুলের ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মীর শহীদ মণ্ডল, আবুল খালেদ, মজিবউদ্দীন মণ্ডল, আমানউল্লাহ, আমিনুর রহমান প্রমুখ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সাহসী ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে আগে গঠিত স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিও ছিল তৎপর।
বলাবাহুল্য , স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে এ অঞ্চলে ১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলন সুস্পষ্ট রূপ নিতে পারেনি; কিন্তু ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর চরিত্রবদল প্রধানত পূর্বোক্ত কারণে। এ ক্ষেত্রে জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সক্রিয় হয়ে ওঠে স্কুলছাত্র ও স্থানীয় যুবকেরা। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের সংবাদ ছাত্র -যুবক ও জনমনে প্রবল সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সভা -সমাবেশ, মিছিল ও স্লোগানে পাঁচবিবি মুখর হয়ে ওঠে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’,‘পুলিশের জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি হয়ে ওঠে প্রধান স্লোগান।
অবশ্য আন্দোলনের সূচনা ঢাকায় ঘোষিত ১১ ফেব্রুয়ারির পতাকা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভাষার দাবি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের ভাষিক তৎপরতার মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে গণসংযোগ, ইশতেহার বিলি ও প্রচার। এ ছাড়া ছোট ছোট সভা -সমাবেশ তো রয়েছেই।
ঢাকা থেকে আসা সংবাদপত্র ছিল আন্দোলন-বিষয়ক খবর সরবরাহের প্রধান মাধ্যম। প্রদেশের অন্যান্য শহরের মতো এ অঞ্চলেও একুশের আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সভা ও মিছিলের মাধ্যমে। এ তৎপরতার ধারাবাহিকতায় ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচবিবিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা। এতে সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কলিমুদ্দীন। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন স্থানীয় ছাত্রনেতা মীর শহীদউদ্দিন মণ্ডল। এদিন শিক্ষকদের উদ্যোগেও একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দুই.
একই ধারায় আন্দোলন শুরু আক্কেলপুরেও ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্রধর্মঘট, ছাত্রসভা, মিছিল ও স্লোগানের মধ্য দিয়ে। ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন কবি আতাউর রহমান। ব্যতিক্রমী ঘটনা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা মজিবর রহমানের উপস্থিতি এবং ঢাকায় গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বক্তৃতা।
এভাবে একুশের আন্দোলন আক্কেলপুর সদর থেকে এর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, ছাত্র আন্দোলন গণ -আন্দোলনে পরিণত হয় । একুশের আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। আক্কেলপুরে কবি আতাউর রহমানসহ আরও যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন , তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হাশেম আলী খান, মনতেছের রহমান, আজিজার রহমান, প্রভাসচন্দ্র রায়, কাজী আবদুল বারী প্রমুখ বিশিষ্টজন। আক্কেলপুরেও গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি , যা বিভিন্ন মত ও পথের লোকজনকে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হতে বা সমর্থন জানাতে সাহায্য করেছিল।