স্বাস্থ্যখাতে অগ্রযাত্রার ৫০: আজ পর্ব—২৭
স্বাস্থ্যে প্রবাসীদেরও অবদান আছে
প্রবাসীদের কথা উঠলেই অর্থনীতিতে তাঁদের অবদানের বিষয়টি সামনে আসে। প্রবাসীরা তিনভাবে স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
করোনা মহামারির সময় একটি খবর অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বারডেম হাসপাতালকে ১৩০টি ভেন্টিলেটর ও বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) দান করেছিলেন। স্বাস্থ্য খাতে প্রবাসীদের অবদানের এটাই প্রথম ও একমাত্র উদাহরণ নয়। প্রবাসীরা বহু বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে আসছেন।
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের যে অর্জন, তাতে প্রবাসীদেরও ভূমিকা আছে। অর্থনীতিতে প্রবাসীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হলেও স্বাস্থ্য খাতে তাঁদের অবদানের কথা খুব একটা আলোচনায় আসে না। এ নিয়ে বড় ধরনের অনুসন্ধান বা গবেষণার কথাও শোনা যায় না। তবে ছোট পরিসরে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবাসী নারীদের পাঠানো অর্থে তাঁদের ৮০ শতাংশ পরিবারে ভালো আবাসন, পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় ব্যয় বেড়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কত প্রবাসী আছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে প্রবাসীদের অনুমিত সংখ্যা ১ কোটি বা তার কিছু বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী আছেন। তবে এঁদের বড় সংখ্যাটি অদক্ষ শ্রমিক। পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন চিকিৎসকেরা।
বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার একটি অংশ চিকিৎসা বা ওষুধপথ্য কেনার জন্য ব্যয় হয়। অন্যদিকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি চিকিৎসকেরা এ দেশের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা ব্যাপারে সহায়তা করেন। প্রবাসীদের এই অবদানের স্বীকৃতি থাকা উচিত।অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব সাবেক সভাপতি, বিএমএ
বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার একটি অংশ চিকিৎসা বা ওষুধ কেনার জন্য ব্যয় হয়। অন্যদিকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি চিকিৎসকেরা এ দেশের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা ব্যাপারে সহায়তা করে। প্রবাসীদের এই অবদানের স্বীকৃতি থাকা উচিত।
প্রবাসীদের পরিবারে স্বাস্থ্য ভালো
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি। এই মহামারির সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা ২ লাখ ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। এই অর্থ বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ। এই অর্থ আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ, অবকাঠামো নির্মাণসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এককভাবে বড় ভূমিকা রাখছে, যার সামষ্টিক প্রভাব আছে স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে। এ ছাড়া পরিবারে পাঠানো অর্থের মাধ্যমে অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা হয়।
বাংলাদেশ বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী শ্রমিকের দেশ। অভিবাসী শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকও আছেন। একটি হিসাব বলছে, এঁদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। ফরিদপুর জেলার চর ভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর ও গাজীরটেক ইউনিয়নের ৯৫ শতাংশ পরিবার এবং চর ভদ্রাসন ইউনিয়নের ২৫ শতাংশ পরিবার থেকে নারী অভিবাসী শ্রমিকেরা সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননে কাজ করেন। এসব নারীর পরিবার নিয়ে জরিপ করেছে বেসরকারি সংস্থা কারিতাস ও অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি।
জরিপ ফলাফলে দেখা গেছে, অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারের ৬১ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে সেবা পায়, অন্য পরিবারের ক্ষেত্রে তা ৩৯ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে প্রবাসী আয় চিকিৎসার জন্য খরচ করা হয়। নারী অভিবাসীদের পাঠানো টাকার ২০ শতাংশ খরচ করা হয় খাদ্যের পেছনে। গবেষকেরা বলছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারে অন্য পরিবারের তুলনায় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বেশি কেনা হয়। তবে গবেষকেরা এ–ও বলছেন, প্রবাসী আয় প্রয়োজনের সময় যে স্বাস্থ্যসেবায় খরচ করা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
চিকিৎসা সহায়তা
জটিল রোগে আক্রান্ত বগুড়ার তিন বছরের শিশু অর্পিতা রায়কে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন ড. বিমলাংশু দে। সিলেটে জন্ম নেওয়া বিমলাংশু দে যুক্তরাষ্ট্রে বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক। মেরুরজ্জু প্রতিস্থাপন বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ।
এর আগে ২০১২-১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেরুরজ্জু প্রতিস্থাপন চিকিৎসা চালু করার ব্যাপারে বিমলাংশু দে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই প্রবাসী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে মেরুরজ্জু প্রতিস্থাপনের বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এ রকম অনেক চিকিৎসক দেশে এসে সরাসরি চিকিৎসায় অংশ নেন, বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন। উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী চিকিৎসকেরা সংগঠন গড়ে তুলেছেন। নাম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন—নর্থ আমেরিকা। এই সংগঠন ব্যক্তি চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেয়।
গবেষণায় অবদান
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিসিসান মেডিসিনের ডিন অধ্যাপক হাবিবুল আহসান ক্যানসার গবেষণায় সহায়তা করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এই গবেষণা করছে। এর আগে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় অধ্যাপক হাবিবুল আহসান আর্সেনিকের বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা গবেষণায় বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে। আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশি গবেষকেরা অনেকেই বাংলাদেশে গবেষণা করতে আগ্রহী, গবেষণা করছেন। তাঁদের সহযোগিতায়, তাঁদের সঙ্গে থেকে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে। এতে দেশের গবেষকদের দক্ষতা বাড়ছে। সুফল পাচ্ছে দেশ।