হাতঘড়িটা খুলছেন না মা আয়েশা
বিএম কনটেইনার ডিপোর পেছনে রেললাইনের ধারে বেড়ার ঘর। সেখান থেকে বের হয়ে এলেন আয়েশা বেগম। ডান হাতে একটি জেন্টস ঘড়ি পরা। রোববার থেকে তিনি হাতঘড়িটি পরে রয়েছেন। কারণ, ঘড়িটি তাঁর আদরের ছেলে শহীদুল ইসলামের (১৬)। শনিবার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে শহীদুল।
শহীদুল রাজা কাশেম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। তার বড় ভাই দিদারুল ইসলাম ডিপোতে পিয়নের চাকরি করেন। বাবা জাকির হোসেনও ঝাড়ুদার হিসেবে ওখানে চাকরিরত। ভাইয়ের বদলি হিসেবে শহীদুল কয়েক দিন সেখানে পিয়নের কাজ করছিল। আর সেটাই কাল হলো শহীদুলের জন্য।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয় সে। আটটা থেকে কাজে যোগ দেয়। এরপর আগুন দেখে ঘর থেকে তার বাবা দৌড়ে ডিপোতে যান। কিন্তু ছেলেকে পাননি। এর মধ্যে ঘটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তাতে বাবা জাকির নিজেও আহত হন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু শহীদুল নিখোঁজ।
আয়েশা বেগম ছেলের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘আগুন দেখে বাপ দৌড় দেয়। কিন্তু ছেলেকে পায়নি। এখন নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে হাসপাতালে। ’
হাতঘড়িটি দেখিয়ে বললেন, ‘ঈদের সময় শখ করে ছেলে ঘড়িটি কিনেছিল। এখন এটাই আমার কাছে তার অনেক বড় স্মৃতি। জীবিত হোক বা মৃত হোক আমার ছেলেকে এনে দিন।’
বড় ভাই দিদারুল ইসলাম এ সময় মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আমি কাজে যাইনি রাগ করে। আমার বদলি হিসেবে ভাই কাজ করছিল। ১৮ দিন কাজ করেছে সে। শনিবার দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ সে। কাল ডিএনএর জন্য নমুনাও দিয়ে এসেছি। এখন জানি না কী হয়।’
ফকিরহাটের বাসিন্দা মনির হোসেনও নিখোঁজ রয়েছেন শনিবার থেকে। তাঁর ভাই আবদুল করিম আজ মঙ্গলবার দুপুরে ডিপোর গেটে ভাইয়ের ছবি নিয়ে হাজির হন। গতকাল সোমবার চমেক হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ডিএনএর জন্য নমুনা দিয়ে এসেছেন তিনি।
আবদুল করিম বলেন, ‘শুনলাম নিখোঁজদের তালিকা করছে ডিপোতে। তাই ছবি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু নাম নিচ্ছে না।’
মনির হোসেন সেদিন রাত আটটায় কাজে যোগ দেন। তিনি ক্রেনচালক। যোগ দেওয়ার পর রাতে স্ত্রী রহিমা আকতারের সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। অসুস্থ স্ত্রী ওষুধপত্র খেয়েছে কি না, সেই খবর নিয়েছিলেন।
আবদুল করিম বলেন, ‘সাত মাস আগে বিয়ে করেছে মনির। স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডিপোতে গিয়ে স্ত্রী ওষুধপত্র খেয়েছে কি না, জানতে চেয়েছিল। তারপর বলে এখানে আগুন লেগেছে। কিন্তু এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাইনি। এখন তার অনাগত সন্তানটির কী হবে জানি না।’
শহীদুল ও আবদুল করিমের মতো নিখোঁজের ছড়াছড়ি এখনো। মহাসড়ক থেকে বিএম ডিপোতে ঢোকার মুখের উপসড়কের মুখে লাগানো হয়েছে নিখোঁজদের ছবিসংবলিত পোস্টার। সেখানে মনির হোসেনের ছবিও রয়েছে।
গত শনিবার রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার ৬১ ঘণ্টা পর আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।