হারিয়ে যাচ্ছে গারোদের মাতৃভাষা 'আচিক'

টাঙ্গাইলের আদিবাসী গারো-অধ্যুষিত মধুপুর অঞ্চল থেকে আচিক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। গারোদের মাতৃভাষা আচিক রক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এ অবস্থা হচ্ছে বলে আদিবাসীরা অভিযোগ করেছেন। এ ভাষা রক্ষায় গারো শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
মধুপুরের আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃ জানান, আচিক ভাষার লিখিত কোনো বর্ণমালা নেই। কথিত আছে, দুর্ভিক্ষপীড়িত তিব্বত অঞ্চল ত্যাগ করে গারোরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আসছিলেন, তখন যাঁর কাছে পশুর চামড়ায় লিখিত আচিক ভাষার পুঁথি-পুস্তকাদি ছিল, সেই ব্যক্তি পথে ক্ষুধার জ্বালায় সব পুঁথি-পুস্তক সেদ্ধ করে খেয়ে ফেলেন। তিনি সম্পূর্ণ ব্যাপারটি গোপন রাখেন। এ উপমহাদেশে আগমন ও বসতি স্থাপনের দীর্ঘদিন পরে ঘটনাটি প্রকাশ পায়। কিন্তু তত দিনে গারো বর্ণমালা বিস্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। কারণ, এ উপমহাদেশে প্রবেশের পর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং স্থায়ী বাসযোগ্য স্থান নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ করে অভিজ্ঞ গারোরা প্রাণ হারান। ফলে আচিক ভাষার বর্ণমালা চিরতরে হারিয়ে যায়। তবে গারোদের মুখে মুখে আচিক ভাষার প্রচলন ছিল।
মধুপুরের গারো ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একটা সময় ছিল, যখন এ অঞ্চলের গারোরা আচিক ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না বা ব্যবহার করতেন না। কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে অথবা লেখাপড়া করতে বনের সন্তান গারোরা এসেছেন তাঁদের আশপাশে বাঙালিপ্রধান এলাকায়। বাঙালিরা গিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন আদিবাসী এলাকায়। এভাবে একসময় নিজ এলাকাতেই আদিবাসী গারোরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। গারো শিক্ষার্থীদের স্কুলে লেখাপড়া বাংলা মাধ্যমেই করতে হয়। কর্মজীবনে অফিস-আদালতসহ সব কাজেই তাঁদের বাংলা ব্যবহার করতে হয়। এ কারণে তাঁদের মাতৃভাষার চর্চা কমে যায়।
আদিবাসী নেতারা জানান, বাংলাদেশে প্রায় সোয়া লাখ গারো আদিবাসী রয়েছেন। যাঁদের প্রায় ২৫ হাজারের বসবাস মধুপুর গড় অঞ্চলে। সম্প্রতি মধুপুর গড় এলাকায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের অধিকাংশই তাদের মাতৃভাষা ভালোভাবে জানে না। কেউ কেউ নিজ বাড়িতে মা-বাবার মুখে শুনে এ ভাষা সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে শিখলেও তারা আচিক ভাষায় উত্তর দিতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন মধুপুর শাখার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ঝুমুর মৃ বলেন, ‘মাতৃভাষা ধরে রাখার জন্য আমরা নিজেরা বাড়িতে সব সময় আচিক ভাষায় কথা বলি। তবু আমাদের ভাষা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলার সঙ্গে ক্রমেই মিশে যাচ্ছে।’
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গড় এলাকায় ১২টি স্কুল চালু করা হয়েছিল; যেখানে গারো শিশুদের আচিক ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। তিন বছর চলার পর দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
আদিবাসী লেখক রাখী ম্রং বলেন, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। গারো শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে আগামী প্রজন্ম হয়তো এ ভাষা হারিয়ে ফেলবে।