৪১ প্রকল্পে ধীরগতি, বড় কারণ প্রস্তুতিতে ঘাটতি

সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের ৫৮টি প্রকল্প পর্যালোচনা করেছে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এর মধ্যে ৪১টি প্রকল্পই চলছে ধীরগতিতে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি

দেশের ১ হাজার ৮০০টি মাদ্রাসার উন্নয়নে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে একটি প্রকল্প নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের মেয়াদ গত জুন মাসে শেষ হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। ইতিমধ্যে প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এক প্রতিবেদনে বলেছে, মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তালিকাভুক্ত ছিল ১ হাজার ৭২১টি। পরে প্রকল্পে আরও ৩৩টি মাদ্রাসার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব মাদ্রাসার উন্নয়নে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন সাংসদদের। কিন্তু ভুলক্রমে নন-এমপিও ১৯টি মাদ্রাসাকেও তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে সেগুলোকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ধরা হলেও প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে।

প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার পর বেশির ভাগ প্রকল্পের প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়। সমীক্ষা, জমি অধিগ্রহণ, কারিগরি নকশার কাজ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। তা না হলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে, সময়ও বেশি লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক বিদ্যুৎসচিব এবং বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ

এই প্রকল্পের মতোই কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। একইভাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর চিত্র অনেকটা এ রকমই। সরকারের এই দুটি মন্ত্রণালয়ের ৫৮টি প্রকল্প পর্যালোচনা করেছে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এর মধ্যে ৪১টি প্রকল্পই চলছে ধীরগতিতে। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সংসদীয় কমিটি দ্রুত কাজ শেষ করতে পরামর্শ দিয়েছে। কমিটি মনে করে, প্রকল্পের সমীক্ষা, সক্ষমতা যাচাই, প্রাক্কলন এসব বিষয়ে ঘাটতি থাকলে পরে বাস্তবায়নে গিয়ে সমস্যা হয়।

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে কমিটির বৈঠকে এসব প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠক সূত্র জানায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৩০টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে ১৭টির অগ্রগতি ২৬ শতাংশের কম, ২টির অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম এবং বাকি ৯টির অগ্রগতি ৫০ শতাংশের বেশি। যেসব প্রকল্পের অগ্রগতি বেশি তার কয়েকটির মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। অন্যগুলোর মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বর ও আগামী বছরের জুনে শেষ হবে।

অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১৭টি প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পেরই কাজ প্রথমে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে শেষ করতে পারেনি। এগুলো বাস্তবায়নে সময় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পে মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে।

এ ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের প্রকল্প চলছে ১১টি। এর মধ্যে নয়টি প্রকল্পেরই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যার দুটিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ের সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে।

বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবদুস শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দুটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। বেশির ভাগ প্রকল্পেরই বাস্তবায়ন অগ্রগতি খুবই ধীর। কিছু প্রকল্পে দেখা গেছে, আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি একই রকম। এটা হওয়ার কথা নয়। কমিটি মনে করে, প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তদারকি আরও শক্তিশালী করা দরকার।

আবদুস শহীদ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কথা তুলেছে। তবে প্রকল্পের সমীক্ষা, সক্ষমতা যাচাই, প্রাক্কলন এসব বিষয় যদি ঠিকমতো হয়, তবে বাস্তবায়ন সহজ হয়।

বৈঠক সূত্র জানায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুনীল অর্থনীতি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য প্রতিবেশ সম্পদের সমীক্ষা চালাতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। এর মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও অগ্রগতি খুবই সামান্য। গত জুলাই পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় আছে মাত্র চার মাস, অথচ সিংহভাগ কাজই এখনো বাকি।

‘পরিবেশ অধিদপ্তরের অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণাগার স্থাপন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে, আর অনুমোদন করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের জুনে। আড়াই বছরে এই প্রকল্পের কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ০২ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতিও ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ।

সংসদীয় কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীন চলমান প্রকল্পগুলোর আর্থিক বিবৃতিসহ প্রতিবেদন আগামী দুই মাসের মধ্যে কমিটির কাছে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

প্রকল্পে ধীরগতির বিষয়ে সাবেক বিদ্যুৎসচিব এবং বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে কিছু কাজ ব্যাহত হচ্ছে এটি ঠিক। কিন্তু মূল সমস্যা হলো প্রস্তুতি ছাড়াই প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার পর বেশির ভাগ প্রকল্পের প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়। সমীক্ষা, জমি অধিগ্রহণ, কারিগরি নকশার কাজ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। তা না হলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে, সময়ও বেশি লাগবে।