মায়ের কাছে আদুরির একটাই আবদার—‘মা, আমি যদি ভালা হই, আমারে আর তুমি এইহানে থুইয়্যা যাবা না।’ এ কথা জানিয়ে আদুরির মা সাফিয়া বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনিও বলতে থাকেন, ‘আমি আর ভুল করুম না। মাইয়্যারে আর মানুষের বাড়িত কামে দিমু না।’
আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) কথা হয় আদুরির মায়ের সঙ্গে। কান্না আর পটুয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা আদুরির মায়ের বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট ঠেকে। তার পরও এই মায়ের চোখের পানিই সব বলে দেয়।
গৃহকর্মী আদুরি এখন সবার পরিচিত। শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতনের পর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মরে গেছে ভেবে। গত ২২ সেপ্টেম্বর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে অর্ধমৃত অবস্থায় ১১ বছরের আদুরিকে খুঁজে পান দুজন নারী। এরপর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওসিসিতে এখন আদুরি একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছে। মাথায় একটি হাড়ে ফাটল ও ভাঙা থাকায় তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। মুখের চারপাশে দগদগে ঘা। মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। গোলাপি প্রিন্টের একটি জামা পরা। এর মধ্যেই সে কানে দুল পরেছে। গলায় একটি মালাও পরেছে। লিকলিকে শরীর। এখনো আদুরিকে দেখলে আঁতকে উঠতে হয়।
আজ সকালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি ওসিসিতে আদুরিকে দেখতে যান। তিনি আদুরির জন্য জামা ও বিভিন্ন ফল নিয়ে যান। কিন্তু তার কাছে গিয়েই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ওহ, এ অবস্থা কেমন করে হতে পারে!’
প্রতিমন্ত্রী আদুরির কাছে নাম জানতে চাইলে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে আদুরি। ‘তুমি ভালো হয়ে যাবে’ বলে প্রতিমন্ত্রী তাকে আশ্বাস দেন। পরে সেখান থেকে বের হয়ে প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আদুরির মামলাটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেছে। আদুরির ভাষ্য আরেকটু স্পষ্ট হলে আসল পরিস্থিতি স্পষ্ট হবে। আর আসামি তো রিমান্ডে স্বীকারও করেছেন আদুরিকে নির্যাতনের বিষয়টি। এ মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অন্যরাও গৃহকর্মী শিশুদের নির্যাতন করতে ভয় পাবে।
এ সময় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন এবং আদুরির শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন।
নির্যাতনের ধরন
আদুরির মা প্রথম আলো ডটকমকে জানান, আদুরি একটু পরপর নির্যাতনের কথাগুলোই বলছে। আদুরি জানিয়েছে, তাকে খাবার দেওয়া হতো না। মুখের মধ্যে আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দিত। আয়রন (ইস্ত্রি) দিয়ে ছ্যাঁকা দিত। ব্লেড দিয়ে সারা শরীর কেটে দিত। বারান্দায় নিয়ে ধাক্কা মারত। পরে তো মারতে মারতে ডাস্টবিনেই ফেলে দেয়।
আদুরির মায়ের এখন একটাই চাওয়া, তাঁর মেয়েকে যেভাবে মেরেছে, তাদেরও যেন ঠিক একইভাবে মারা হয়। তাদের যেন কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
ওসিসির সমন্বয়কারী চিকিত্সক বিলকিছ বেগম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, আদুরির শারীরিক অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে। রক্তশূন্যতা ও অপুষ্টি আছে। তার লিভার বড় হয়ে গেছে। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার চিকিত্সা চলছে।
আদুরির আরেক বোনেরও খোঁজ নেই
আদুরিরা চার ভাই ও পাঁচ বোন। তার ছোট আরও দুই বোন আছে। মাত্র এক বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাইয়েরা নদীতে মাছ ধরে। বাবা তিন বছর আগে মারা গেছেন। অভাবের কারণে এলাকার দালাল চুন্নু মিয়ার মাধ্যমে আদুরির মা সে ও তার আর এক বোনকে বছর খানেক আগে ঢাকায় কাজ করতে পাঠান। তবে এই দুই মেয়ে কোথায়, কার বাসায় কাজ করে, তার কিছুই জানেন না মা।
আদুরির বেতনের ৫০০ টাকা চুন্নু মিয়া তাঁর হাতে দিতেন। আদুরির ঘটনার পর চুন্নু মিয়াই ফোন করে আদুরির খোঁজ দেন। এই মা এখন অন্য মেয়ের খোঁজ জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। শুধু জানেন, ঢাকায় এক জজ সাহেবের বাসায় তাঁর অন্য মেয়ে কাজ করে। এখন চুন্নু মিয়ার ফোনও বন্ধ। প্রতিবেদককে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে এই মা আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমার আরেক মাইয়্যারেও আইন্যা দেন। দুই মাইয়্যারে নিয়া দেশে যামু।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মেরিন সুলতানা প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, আজ মঙ্গলবার মামলার আসামি নওরীন জাহান ওরফে নদীর রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য আদালতে নেওয়া হয়েছে। এখন ইনভেস্টিগেশন বিভাগ থেকে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
মেরিন সুলতানা বলেন, নদী আদুরিকে নির্যাতন করার কথা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে নদী নিজে আদুরিকে ডাস্টবিনে ফেলে আসেননি বলে জানিয়েছেন। কথা শুনত না, এক কথা বারবার বলতে হতো, কাজে মনোযোগ দিত না ইত্যাদি কারণেই তিনি আদুরিকে নির্যাতন করতেন বলে জানিয়েছেন।
পটুয়াখালী পুলিশের সহায়তায় চুন্নু মিয়ার কাছ থেকে নওরীন জাহানের ঠিকানা নেওয়া হয়। পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ২৯/১ সাগুফতা বাড়ি কল্যাণ সমিতির দ্বিতীয় তলার বাসা থেকে পল্লবী থানার সহায়তায় নওরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর আদুরির মামা বাদী হয়ে মামলা করেন।