
এই সময়ে চট্টগ্রামের বাসায় আসার কথা ছিল না সাইদুর রহমানের। কিন্তু এর মধ্যেই ৮ জুলাই শোনেন, পরিবারে নতুন অতিথি এসেছে। বড় ভাইয়ের স্ত্রী জন্ম দিয়েছেন কন্যাসন্তানের। এমন সুসংবাদে মন আর কি মানে? তাই ১৮ জুলাই ছুটে এলেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভাতিজির নামও দেন—মাহানুর রহমান।
ভাতিজির সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে গত শনিবার রাতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান ওরফে পায়েল। সোমবার গজারিয়ার ভরের চরে নদীতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এরপর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সাইদুর বাথরুমের কথা বলে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। ফের গাড়িতে ওঠার সময় আহত হয়েছিলেন তিনি। পরে রক্তাক্ত সাইদুরকে হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে নদীতে ফেলে দেন বাসের কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাসায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় সাইদুরের বাবা গোলাম মাওলা, মা কোহিনুর আক্তার আর বড় ভাই গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। কোহিনুর আক্তারের স্বামী গোলাম মাওলা আর বড় ছেলে গোলাম মোস্তফা কাতারপ্রবাসী। বড় মেয়ে শামিমা আক্তারও বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তাই ছোট ছেলে সাইদুর রহমান ছিল মা কোহিনুর বেগমের সব আবেগ আর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। সাইদুরেরও সব বায়না ছিল মাকে ঘিরেই। সেই ছেলেটাই আচমকা জীবন থেকে সরে গিয়ে স্মৃতি হয়ে গেলেন। কোনোভাবেই মানতে পারছেন না মা কোহিনুর বেগম।
ঢাকা থেকে বাসায় ফিরলে যে খাটে ঘুমাতেন সাইদুর, সেই শূন্য খাটের দিকে তাকিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়া কোহিনুর বেগম বলেন, ‘হাসিমুখেই আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল ও। গাড়িতে উঠেই ফোন দিয়ে বলেছিল, “মা, টেনশন কোরো না, ভোরে পৌঁছেই ফোন দেব।” কিন্তু সেই ফোন আর এল না।’
সাইদুরের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর গত সোমবার দেশে ছুটে আসেন সাইদুরের বাবা ও বড় ভাই। শেষবার যখন কথা হয়, তখন বাবার কাছে একটি নতুন মুঠোফোনের বায়না ধরেছিলেন সাইদুর। সেসব স্মৃতি মনে করে পুড়ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব গোলাম মাওলা। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস পরেই আমার দেশে আসার কথা ছিল। তখন ছেলের জন্য মুঠোফোন নিয়ে আসব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার আর সেই মুঠোফোন আনা হয়নি। আমার ছেলে যদি কোনো অপরাধ করত, তাহলে কিছুটা হলেও মানতে পারতাম। আমি আমার ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি চাই।’
বড় ভাই গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলাম মাহানুর মোস্তফা। কিন্তু ছোট ভাই বলল, তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখতে। তাই তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়েই নাম ঠিক করা হয়েছিল মেয়ের। কেন আমার ভাইকে এভাবে মেরে ফেলা হলো?’
বেশ ভদ্র ছেলে হিসেবেই এলাকায় পরিচিতি ছিল সাইদুরের। তাই তাঁর মৃত্যুসংবাদের চেনা, আধচেনা লোকজন ভিড় করছেন তাঁর বাসায়। সবাই শোকার্ত। বলছিলেন তাঁকে নিয়ে নানা স্মৃতির কথা। সাইদুরের বাসায় ভিড় করছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। আজ সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকর্মীরা বিদায় নেওয়ার সময় হঠাৎ থামিয়ে একটা আবদার করলেন সাইদুরের বাবা গোলাম মাওলা। বললেন, ‘সোমবার দেশে ফিরলেও ছেলেকে দেখতে পারিনি। কারণ তাঁর লাশ বেশি বিকৃত হয়ে যাওয়ায় কফিন খোলা হয়নি। আমি এখন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখতে চাই। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি করতে চাই, কেন আমার নির্দোষ ছেলেকে এভাবে মেরে ফেলল?’