'বৃক্ষ-মানবের' চিকিৎসার ভার নেবে সরকার: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ঢাকায় আসার পর প্রায় সাত দিন পেরিয়ে গেলেও ‘বৃক্ষ-মানব’ আবুল বাজনদারের চিকিৎসা প্রক্রিয়া কার্যত শুরুই হয়নি। তবে আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আবুলের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি আবুলকে দেখতে আজ সেখানে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে বার্ন ইউনিটের মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে বা বিদেশে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই আবুল বাজনদারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য তাঁকে বা তাঁর পরিবারের কাউকে এক পয়সা খরচ করতে হবে না।’ তিনি সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সংবাদকর্মী ও দর্শনার্থীদের আবুল বাজনদারের কক্ষে ভিড় না জমানোর অনুরোধ জানান।
আজই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, আবুলের সমস্যা ও চিকিৎসা কোন পর্যায়ে আছে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, সম্ভবত আবুলের এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিমরফিস নামের একটি বিরল রোগে ভুগছেন। এ রোগটি ট্রি-ম্যান সিনড্রোম নামে পরিচিত। বছর দশেক আগে আবুলের হাঁটুর নিচের দিকে ছোট ছোট কয়েকটি কালো রঙের আঁচিল দেখতে পান। এগুলো ধীরে ধীরে তাঁর দুই পা এবং পরে হাতে ছড়িয়ে পড়ে। হাতের আঁচিলগুলো দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন দেখতে গাছের শুকনো বাকলের মতো মনে হয়। পাঁচ বছর ধরে আবুল কোনো কাজ করতে পারেন না।
গত ৩০ জানুয়ারি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হন আবুল। এর আগে তিনি পাঁচবার কলকাতায় চিকিৎসা নিয়েছেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধও খেয়েছেন। অনেক দিন ধরেই আবুল নিজে হাতে খেতে পারেন না। তিনি অপুষ্টিতে ভুগছেন।
সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমাদের চেষ্টাটা হলো, সে যেন হাতটি দিয়ে দু-মুঠো ভাত তুলে খেতে পারে।’
আবুলের স্ত্রী হালিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনার খাওয়ার চাহিদা আছে। খাতি পারে না। একটা মেয়ে আছে আমাগের। মেয়ে বাপ ভক্ত। কিন্তু ছুঁয়ে দেখতে পারে না।’
আবুল হাসপাতালে ভর্তির পরপরই ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর বুড়ো আঙুল ও তর্জনীটি সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত প্রচারের পর একজন শীর্ষস্থানীয় চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ সরকার মাহবুব আহমেদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে অস্ত্রোপচার না করার অনুরোধ জানান। গত মঙ্গলবার মেডিকেল বোর্ডের অনুমতি নিয়ে রোগীটিকে দেখতে যান তিনি। পরে বলেন, রোগীটির হাত-পায়ে শেকড়ের মতো বৃদ্ধিটা থামাতে হবে। পরে লেজারের মাধ্যমে বেড়ে যাওয়া অংশগুলোকে ছোট করে এনে অস্ত্রোপচারে যাওয়া যেতে পারে।
মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বলেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল হাতে না আসা পর্যন্ত তাঁরা অস্ত্রোপচারের দিকে যাবেন না। এই বোর্ডের চার সদস্য বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির, অপর দুজনের একজন মেডিসিন বিভাগের এবং অন্যজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। আবুলের চিকিৎসায় প্লাস্টিক সার্জারির ভূমিকা কতটা এবং আরও ব্যাপক ভিত্তিতে চিকিৎসকদের সম্পৃক্ত করা ও আলাপ-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন কি না সাংবাদিকেরা আজ এই প্রশ্ন তোলেন। উত্তরে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান এবং বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম বলেন, অস্ত্রোপচারের পর বিকৃতি দূর করতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন হবে। তিনি আরও বলেন, রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আবুলের রক্ত, লালা ও অন্যান্য নমুনা দেশে বা বিদেশের কোনো গবেষণাগারে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে পারেননি চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় লস অ্যাঞ্জেলসের নোরিস কমিস্প্রহেনসিভ ক্যানসার কেয়ার সেন্টারে নমুনাগুলো পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশেও (আইসিডিডিআর, বি) কিছু নমুনা পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
চিকিৎসকেরা ধারণা করছেন আবুলের দেহে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। জিনগত সমস্যাও থেকে এ রোগটি হয়ে থাকতে পারে। চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ৫০টি ধরন আছে। কোনো কোনোটির কারণে মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। বাংলাদেশে ঠিক কোন ধরনটি আবুলের দেহে সক্রিয় তা জানার সুযোগ নেই। সে কারণেই নমুনাটি ডব্লিউএইচও অনুমোদিত গবেষণাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সারা বিশ্বে আবুলসহ চারজন ট্রি-ম্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে। এদের একজন রুমানিয়া ও অপর দুজন ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক। ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক ডেডে কোসোওয়ারা গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও, পরে আবারও তাঁর হাত-পায়ে শেকড়ের মতো বৃদ্ধি দেখা দেয়। জাকার্তা পোস্টের খবর গত ৩০ জানুয়ারি ডেডে ইন্দোনেশিয়ার একটি হাসপাতালে মারা যান। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রায় শেকড়ের মতো দেখতে ছয় কেজি পরিমাণ চামড়া সরানোর কয়েক মাস পর নতুন করে ডেডে কোসোওয়ারার শরীরে আবারও একই রকম বৃদ্ধি দেখা যায়। কেমোথেরাপি দিয়েও তা ঠেকানো যায়নি।

আরও পড়ুন: