গরিবের চাল পাচ্ছেন ধনীরা

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সেকান্দরনগর গ্রামের (নয়াপাড়া) বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম গত বৈশাখ মাসে ৬০০ মণ ধান পেয়েছেন। তাঁর বসতঘরে রয়েছে ফ্রিজ, রঙিন টেলিভিশনসহ মূল্যবান আসবাব। ব্যাটারিচালিত চারটি অটোরিকশা, চারটি গরু ও চাষাবাদের জমিও রয়েছে তাঁর।

এই সচ্ছল গৃহস্থের নামই ধলা ইউনিয়নের জন্য প্রস্তুত করা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের তালিকায় রয়েছে। তালিকার ৯৩ ক্রমিকে তাঁর নাম পাওয়া গেছে। অথচ হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করার জন্য সরকার এই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আর চাল পাচ্ছেন ইব্রাহিমের মতো ধনী ব্যক্তিরা।

  ৩০০ টাকা দিয়ে ডিলারের কাছ থেকে ৩০ কেজি চাল কিনে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইব্রাহিমের ছেলে কামরুল ইসলাম। শুধু ইব্রাহিম নন, এই ওয়ার্ডের ৩০ জন সুবিধাভোগীর মধ্যে সাতজনই সচ্ছল। এদের মধ্যে ১০২ ক্রমিকে আলম, ৯৪ ক্রমিকে রফিকুল, ১০৯ ক্রমিকে আনোয়ার হোসেন, ৮৫ ক্রমিকে আফিয়া খাতুন, ৮৮ ক্রমিকে জুয়েনা, ১১৩ ক্রমিকে হারুনা আক্তার ও ১০১ ক্রমিকে গেনু মিয়ার নাম রয়েছে।

অথচ একই ওয়ার্ডের মৃত আবদুল আজিজের স্ত্রী আছিয়া আক্তার একটি কুঁড়েঘরে থাকলেও তাঁর নাম তালিকায় ওঠেনি। আছিয়ার মতো হতদরিদ্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফরিদ মিয়া, বাকপ্রতিবন্ধী আবদুল ওয়াদুদ, ভিক্ষুক মন্নাক মিয়া, আবদুল করিম, আবদুল হাকিমসহ হতদরিদ্র অনেকের নাম তালিকাভুক্ত হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরির সময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য এবং রাজনীতিবিদেরা স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাসেম, শাহিন মিয়াসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, যাঁরা চাল পাওয়ার যোগ্য তাঁদের বাদ দিয়ে ধনীদের নাম তালিকায় রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, তালিকাভুক্ত হয়েও অনেকেই চাল পাচ্ছেন না।

 হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি স্বজনপ্রীতির নজির পাওয়া গেছে। ধলা ইউপির সংরক্ষিত (১, ২, ৩) ওয়ার্ডের সদস্য মাসুমা আক্তারের স্বামী আবদুল কাদির (ক্রমিক ৯১), মেয়ে পান্না আক্তার (ক্রমিক ১০৭), দেবর আবদুল গণি (ক্রমিক ১০৬), চাচাতো দেবর রঞ্জু মিয়া (ক্রমিক ১০৫), ভাগনের স্ত্রী ঝর্না আক্তারসহ পাঁচজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন মাসুমা।

শাহজাহান, তারা মিয়া, আবদুল আজিজসহ কয়েকজন সুবিধাভোগী বলেন, তালিকায় নাম থাকলেও তাঁরা চাল পাননি। রোজিনা আক্তার নামের এক সুবিধাভোগী বলেন, ‘গত দুই দিন আগে মাসুমার জামাই আবদুল কাদির বাড়িতে এসে আমাকে তিন শ টাকা দিছে, চাউল পাই নাই।’ এ ব্যাপারে আবদুল কাদির বলেন, ‘রোজিনা চাল আনতে যায় নাই, এই কারণে ডিলারের কাছ থেকে ৩০০ টাকা এনে তাঁরে দিছি।’

ডিলার মাহবুব আলম বলেন, ‘যাঁরা কার্ড নিয়ে আসে তাঁদের চাল দিই। আমি সবাইকে চিনি না। চালের মূল্য বাবদ কাউকে টাকাপয়সা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. জসিম উদ্দিন দাবি করেন, ‘আমার তালিকা সঠিক, কোনো অনিয়ম হয়নি।’ সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য মাসুমা আক্তার বলেন, ‘আমি নতুন মেম্বার হয়েছি, সবকিছু বুঝতে সময় লাগবে। আপনার সঙ্গে আমি দেখা করব।’ নিজের পরিবারের পাঁচজনকে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি নীরব থাকেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমি কোনো নাম দিইনি। মেম্বাররা ছাড়াওআওয়ামী লীগের নেতারা ৫০টি ও জাতীয় পার্টির নেতারা ৫০টি নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। রাজনীতিক নেতাদের নামের তালিকায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বেশি হয়েছে। আগামী উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় বিষয়টি আমি উত্থাপন করব।’

কারাগারে থাকায় এ বিষয়ে তাড়াইল উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুল জলিলের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

যোগাযোগ করা হলে তাড়াইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতান আক্তার বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ স্থানীয় ব্যক্তিরা তালিকা করেছেন। এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।