তদন্তেই ২০ বছর পার

.
.

‘আমার তদন্তকালে ভিকটিমের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই।...বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করিয়াও ভিকটিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার এবং মামলা-রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় নাই।...প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় নাই। ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে।’
এভাবেই আবারও ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে রাঙামাটির আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অাদালতে জমা দিয়েছেন মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান। গত ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কল্পনা অপহরণ মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তিন বছর আগে দেওয়া ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে বর্তমান প্রতিবেদনের ‘মিল’ রয়েছে। সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. শহীদুল্লাহর দেওয়া ওই প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল ‘সাক্ষ্য ও প্রমাণের অভাবে কল্পনাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে বা উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির পুনরায় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’
১৯৯৬ সালের ১১ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা ।
কল্পনার বড় ভাই ও অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ওই রাতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল কল্পনা চাকমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই সশস্ত্র দলের সঙ্গে থাকা তিনজনকে কল্পনার দুই ভাই কালিন্দী ও লাল বিহারী চাকমা চিনতে পারেন। এই তিনজন হলেন তাঁদের বাড়ির কাছের কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের (ভিডিপি) প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও পিসি সালেহ আহম্মদ।
আদালতে জমা দেওয়া সর্বশেষ চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি এখনো হাতে পাননি কালিন্দী চাকমা। তবে বিষয়টি তিনি জানেন। তিনি এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তদন্তকালে ঘটনার রাতে সেনাসদস্যদের, গমনাগমনের পদ্ধতি, পরের দিন দায়িত্ব পালন, সার্বিক তদন্তে লে. ফেরদৌস, ভিডিপি নুরুল হক ও পিসি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
কল্পনার ভাই কালিন্দী চাকমার পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেছেন আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি যত দিন ধরে এ মামলা দেখছি তাতে চারজন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। তদন্তকাজে আন্তরিকতার ছাপ ছিল না। থাকলে এ ঘটনার একটি সুরাহা হতো।’
জুয়েল দেওয়ান বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার সাক্ষীদের কেউ কেউ এখন আর বেঁচে নেই। কল্পনার মা এ ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এ ঘটনা জানতেন। তিনিও মারা গেছেন।’ জুয়েল দেওয়ান বলেন, মামলার প্রাণ হলো সাক্ষী।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন বাঘাইছড়ি থানায় কল্পনা অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়। থানার তৎকালীন ওসি শহিদউল্ল্যা প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এরপর একে একে ৩৩ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হন। এভাবে ১৪ বছর পার হয়। কিন্তু তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ৩৪তম তদন্ত কর্মকর্তা, ওই থানার উপপরিদর্শক ফারুক আহম্মদ ‘পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না’ বলে দাবি করে ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাঙামাটির মুখ্য বিচারিক হাকিম মামলাটি সিআইডির মাধ্যমে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর দুই বছর তদন্তের পর ৩৫তম তদন্ত কর্মকর্তাও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এই প্রতিবেদনে বাদী নারাজি দিলে আদালত রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেন। রাঙামাটির পুলিশ সুপার মাসুদ-উল-হাসান, আমেনা বেগম এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ মামলাটি তদন্ত করেন।
সর্বশেষ এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন রাঙামাটির বর্তমান পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নিদের্শনা অনুযায়ী কাজ করেছি। তদন্তে সাক্ষী ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে কল্পনা চাকমা অপহরণের ব্যাপারে আগের তদন্ত কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি।’
অপহরণ মামলার তদন্তে ২০ বছর পার হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কেউ অপহৃত হলে তাঁকে খুঁজে বের করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। এ মামলার তদন্তে কালক্ষেপণ হয়েছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থার অভাব দেখা দিতে পারে।