দেশে মিনিটে চারজনের বেশি মানুষ বাড়ছে

বছর শেষে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে ২২ লাখ ২১ হাজার ৮০০ জন, বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করবে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৭ কোটি ১৭ লাখ। আর জাতিসংঘের হিসাবে জনসংখ্যা হবে ১৭ কোটি ২৩ লাখ

দেশে প্রতি মিনিটে ৪ দশমিক ২ জন মানুষ বাড়ছে। ঘণ্টায় বাড়ছে ২৫৩ জন। আর দিনে বাড়ছে ৬ হাজার ৭০ জন। বছর শেষে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন যুক্ত হচ্ছে ২২ লাখ ২১ হাজার ৮০০ মানুষ। বছরে মোট জন্ম ও মোট মৃত্যুর হিসাব থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই তথ্য দিয়েছে সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। তাদের হিসাবে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি ৮৬ লাখ। অর্থাৎ আরও ৫ কোটি ৭৬ লাখ মানুষ বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে বিশ্বব্যাংকের এক দলিলে বলা হয়েছে (পপুলেশন, ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ পলিসি হার্মোনাইজেশন ইন বাংলাদেশ, ২০১৪), এই শতাব্দীর মধ্যভাগে দেশের জনসংখ্যা হবে ২৩ কোটি ৩৫ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি ও সম্পদের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি। বাড়তি জনসংখ্যা খাদ্য, আবাসন ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতিকে সব সময় চাপের মধ্যে রাখবে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীন, ভারত, বাংলাদেশ—তিনটি দেশই জনবহুল। তবে অতিমাত্রায় জনঘনত্ব বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা। ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৪৬ জন মানুষ বাস করে, চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪২ জন। আর বাংলাদেশে ১ হাজার ২০০ জন।’
কীভাবে মানুষ বাড়ছে: নিপোর্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক সুব্রত ভদ্র প্রথম আলোকে বলেন, জন্মহার, মৃত্যুহার, বছরে মোট জন্ম, মোট মৃত্যুর হিসাব এখন পাওয়া যায় স্যাম্পেল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) থেকে। এই গবেষক জানান, জনসংখ্যার হিসাব নেওয়া হয় বছরের মাঝামাঝি (১ জুলাই) সময়ের পরিস্থিতি থেকে। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালে দেশে ৩০ লাখ ৪২ হাজার ৯০০ শিশুর জন্ম হবে। এ বছরে মারা যাবে ৮ লাখ ২১ হাজার ১০০ জন। স্বাভাবিক বৃদ্ধি ২২ লাখ ২১ হাজার ৮০০। তিনি বলেন, জন্ম থেকে মৃত্যু বিয়োগ করে দিন, ঘণ্টা ও মিনিটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রতি মিনিটে ৫.৮টি নবজাতকের জন্ম হচ্ছে। প্রতি মিনিটে ১.৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। মিনিটে স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ৪.২।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বেড়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নির্ভর করে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) কী হবে তার ওপর। বাংলাদেশ জনসংখ্যা খাতে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা সম্ভব হয়েছে টিএফআর কমানোর ক্ষেত্রে। নারী প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত) যে কয়টা সন্তান জন্ম দেয়, সেটাই টিএফআর। স্বাধীনতার সময়, ১৯৭১ সালে টিএফআর ছিল ৬.৪। অর্থাৎ একজন নারী তাঁর জীবদ্দশায় ৬টির বেশি শিশুর জন্ম দিতেন। বর্তমানে টিএফআর ২.৩।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করবে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৭ কোটি ১৭ লাখ। আর জাতিসংঘের হিসাবে জনসংখ্যা হবে ১৭ কোটি ২৩ লাখ।
এই শতাব্দীর মাঝামাঝি অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ওই দলিলে বলা হচ্ছে ২০১৬ সালের মধ্যে টিএফআর ২.০ করা সম্ভব হলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের মানুষ হবে ২১ কোটি ৮০ লাখের ওপর। আর টিএফআর ১.৭ হলে, মানুষ হবে ২০ কোটি ১৩ লাখ। পার্থক্য হবে ১ কোটি ৬৭ লাখ মানুষের। ২০১৬ সাল শেষ হতে চললেও টিএফআর কমানো সম্ভব হয়নি।
জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জ: জনঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবাসন সমস্যা বাড়ছে, ফলে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে। দ্বিতীয়ত, অভিবাসন বৃদ্ধির কারণে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, বস্তির মানুষ বাড়ছে। এই সমস্যাগুলো পুরোনো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নদীভাঙন পুরোনো সমস্যাকে আরও প্রকট করছে।
জনসংখ্যার সমস্যা এক একজন একেকভাবে দেখেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, কর্মসংস্থানের সমস্যাই প্রধান। বিপুলসংখ্যক মানুষকে কার্যকর শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া দেশের প্রায় ৭ শতাংশ মানুষের বয়স ৬০ বছরের ওপর। এদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য দেশ প্রস্তুত নয়।
জনসংখ্যাবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ওবায়দুর রব প্রথম আলোকে বলেন, এখনই মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য অর্থের স্বল্পতা আছে। প্রতিবছর বাড়তি মানুষ যোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে বিনিয়োগের সমস্যা আরও গভীর হবে। তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুব জনগোষ্ঠী বাড়ছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এরাই দেশের সম্পদ হবে। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ আসবে শহরে। এখনই দেশের শহর ও নগরগুলো সমস্যায় জর্জরিত। জরুরি পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিলে সমস্যা আরও প্রকট হবে।
জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম বলেন, বর্তমান ও বর্ধিত জনসংখ্যাকে মানসম্পন্ন শিক্ষার আওতায় আনা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। সামাজিক নিরাপত্তার বড় উদ্যোগ সরকারের আছে। আধুনিক ম্যানুফ্যাকচার ও শিল্পের উপযোগী জনবল তৈরির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরিকল্পনা সরকারের আছে। বর্তমানে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চতর প্রবৃদ্ধির হার ছাড়া এটা সম্ভব হবে না। প্রবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে নিতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে, দারিদ্র্যবিমোচন হবে। সরকার সেই দিকেই এগোচ্ছে।