সার্কের বিকল্প হচ্ছে না বিমসটেক

গত মাসে নাটকীয়ভাবে স্থগিত হয়ে যায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। এরপর থেকেই গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটের নতুন মেরুকরণ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। ‘পাকিস্তানকে ছাড়া সার্ক’—এমন একটা ভাবনা সামনে এলেও শেষ পর্যন্ত সেটি ফলপ্রসূ হয়নি। বিশেষ করে সার্কের বিকল্প জোট হিসেবে বিমসটেক যে যথেষ্ট কার্যকর হবে না, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গোয়ায় ১৬ অক্টোবর শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের পর।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্কের তেমন অর্জন না থাকলেও আর্থসামাজিক বিভিন্ন খাতের বেশ কিছু সফল কর্মসূচি আছে। অন্যদিকে, বিমসটেককে একটি কার্যকর ও গতিশীল সংগঠনে পরিণত করতে সদস্যদেশগুলোর তেমন জোরালো অঙ্গীকার নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিমসটেককে এই মুহূর্তে সার্কের বিকল্প হিসেবে দেখাটা ঠিক হবে না।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের এই জোটের সদস্যদেশগুলো আলাদা বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর বিমসটেক নেতারা একটি ঘোষণা প্রচারে রাজি হন। আলোচনার ওই সম্মত দলিলে দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া এতে আগামী বছর বিমসটেক প্রতিষ্ঠার দুই দশক পূর্তিকে সামনে রেখে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সদস্যদেশগুলোর মধ্যে মোটরযান চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।

গোয়ায় বৈঠকে এসব সিদ্ধান্তের পরও বিমসটেক নিয়ে জোরালো আশাবাদ নেই কেন জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, তিন দশক পরও সার্কের অর্জন নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি দুই দশকে বিমসটেক কী অর্জন করল সেই প্রশ্নও চলে আসে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কৃষিসহ আর্থসামাজিক বিভিন্ন খাতে সার্কের বেশ কিছু সফল কর্মসূচি আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কের উপস্থিতির পর বিকল্প আরেকটি জোট এগিয়ে নিতে হলে একাধিক সদস্যদেশকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিমসটেককে গতিশীল ও জোরদার সংগঠন করতে সদস্যদেশগুলোর অঙ্গীকার তেমন দৃশ্যমান নয়।

ভারতের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, গোয়ার বৈঠকের পর ‘পাকিস্তানকে ছাড়া সার্ক’ এমন ভাবনা এগিয়ে নিতে দিল্লি আগ্রহী নয়। গত শুক্রবার দিল্লিতে এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বলেন, সার্ক নিয়ে ভারতের আগ্রহের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতার জন্য সন্ত্রাসমুক্ত যে পরিবেশ দরকার, একটি সদস্যদেশের তৎপরতার কারণে তার অনুপস্থিত রয়েছে। এ কারণেই জোটের সব দেশ সার্কের বর্তমান সভাপতি নেপালকে জানিয়েছে, ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। সার্কের প্রতি ভারতের অঙ্গীকার অটুট আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরী বলেন, বিমসটেক কিংবা অন্য কোনো আঞ্চলিক জোট সার্কের বিকল্প হতে পারে না। ফারুক চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাকিস্তানের সাম্প্রতিক তৎপরতায় যেভাবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়েছে, তাতে সংস্থাটি যে হোঁচট খেয়েছে এতে সন্দেহ নেই। তবে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্ক এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা জোটের একটি অংশ ছেঁটে ফেলার মতো। তা ছাড়া বিমসটেককে কার্যকর করতে সদস্যদেশগুলোর অঙ্গীকার যথেষ্ট নয়। কাজেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা থাকবে সার্ক টিকে থাকুক।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনে করেন, তিন দশক আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের যে স্বপ্ন নিয়ে সার্ক যাত্রা করেছিল, তা থেকে এখনো বহু দূরে পড়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার এই জোট। দীর্ঘ সময়জুড়ে ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে সার্ক। এর পাশাপাশি সার্ক সনদ অনুযায়ী ‘সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে’ চলার মূলনীতি সার্ককে খুব একটা এগোতে দেয়নি। তাই সার্ক সনদে মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা দুরূহ। ফলে ভবিষ্যতেও সার্কের কার্যক্রম এভাবেই চলতে থাকবে। মোটরযান চুক্তির অভিজ্ঞতায় বলা যায়, সার্কের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) উপ-আঞ্চলিক জোটের সম্ভাবনা বেশ ভালো।

এবার যেভাবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়েছে, সেটা একেবারেই বিরল। কারণ প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও আফগানিস্তান সার্ক সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশের সঙ্গে তিক্ততা বাড়িয়েছে পাকিস্তান। আর গত মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরির সেনাছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার পর নয়াদিল্লির সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক চরম বৈরী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের তিক্ততা চরমে। এহেন অবস্থায় সার্ক যে সংকটে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আগামী তিন মাসে সার্কে মন্ত্রী পর্যায়সহ বিভিন্ন স্তরের যে আটটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তার সবগুলোই স্থগিত হয়ে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাগতিক দেশ হিসেবে পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন প্রায় অসম্ভব।