পরিবারে খুন, সন্দেহে স্বজন

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পোশাক কারখানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতেন সোহানা আক্তার (২৯)। তাঁর হুড়োহুড়ির কারণে পরিবারের অন্যদেরও ঘুম ভেঙে যেত। কিন্তু ৬ অক্টোবর সকাল সাতটা বেজে গেলেও মেয়েকে ঘুম থেকে উঠতে না দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন বাবা। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন মেয়ের শরীর নিথর। মুখ দিয়ে ঝরছে রক্ত।
পুলিশ বলছে, সোহানাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। সন্দেহের তির ঘটনার পর থেকে পলাতক তাঁর স্বামী পরিবহনশ্রমিক মো. রাজীবের দিকে। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে নগরের ডবলমুরিং থানার মৌলভীপাড়ায় বাবার বাড়িতেই থাকতেন সোহানা। এই ঘটনায় তাঁর বাবা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
গত দুই মাসে চট্টগ্রামে এমন আটটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেসব ঘটনার সঙ্গে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাই জড়িত। পারিবারিক এসব সহিংসতার প্রধান শিকার নারীরা হলেও, ছেলের হাতে মা–বাবা ও শ্যালকের হাতে ভগ্নিপতি খুনের ঘটনাও ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়াই এর মূল কারণ।
পুলিশ বলছে, গত কয়েক মাসে বেড়েছে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনা। ২৪ অক্টোবর রাতে নগরের ইপিজেড এলাকায় দাম্পত্য কলহের জের ধরে স্ত্রী আশামনিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন স্বামী খালেক শাহ। স্ত্রীকে হত্যার কথা তিনি স্বীকারও করেছেন পুলিশের কাছে। তাঁদের সাত বছর বয়সী একটি মেয়েও আছে।
এর আগে ১৯ অক্টোবর নগরের পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ভাড়া বাসায় রোজিনা আক্তার নামের এক পোশাককর্মী খুন হন। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১০ অক্টোবর মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রী মরিয়মকে পাথর ছুড়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী মো. রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করেন রুবেল।
ঘরের মধ্যে ছেলে মা-বাবাকেও খুন করতে দ্বিধা করছে না। গত ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম মেখলের কাছিমার বটতল এলাকায় বাবা মো. মুছাকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ ছেলে মো. সারেককে (১৮) গ্রেপ্তার করে।
দুই দিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর নগরের বারিক বিল্ডিং এলাকায় একটি ফ্ল্যাট থেকে কুমকুম চৌধুরীর (৪২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর ছোট ছেলে সুমিত এ বছর নগরের ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বন্দর থানার এসআই সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুমিত তাঁর মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পরীক্ষায় পাস না করায় হতাশা থেকে তিনি এ কাজ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৭ অক্টোবর নগরের টেরিবাজার এলাকার আফিনি গলির বাসা থেকে অঞ্জন ধরের লাশ উদ্ধার করা হয়। নগরের হাজারি গলির একটি সোনার দোকানের কারিগর ছিলেন তিনি। শ্যালক বাবলু ধরও একই দোকানে কাজ করতেন। বাবলু ধর তাঁর বোনাকে নির্যাতনের জন্য ভগ্নিপতিকে হত্যার কথা স্বীকার করে থানায় হাজির হন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, তুচ্ছ ঘটনায় ঘরের ভেতর খুনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব না। এ জন্য পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর পাশাপাশি মা-বাবাকে প্রকৃত অর্থে মা-বাবা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী ইন্দ্রজিৎ কণ্ডু বলেন, তরুণদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কোনো আদর্শ নেই। এগুলো সংস্কারে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় করতে হবে।
পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার ওপর জোর দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি মো. শাহীনুর রহমানও। তিনি বলেন, বিকৃত মানসিকতা, মানসিক বিষণ্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে প্রিয়জনের হাতে প্রিয়জনের হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এসব ঘটনা বন্ধে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খোলামেলা আলাপ আলোচনা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।