গুলিস্তানের পার্কটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা

গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চের পেছনে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করেছে ডিএসসিসি। ফলে পার্কের সবুজ অংশটুকু হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকের l ছবি: প্রথম আলো
গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চের পেছনে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করেছে ডিএসসিসি। ফলে পার্কের সবুজ অংশটুকু হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকের l ছবি: প্রথম আলো

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইউব খানবিরোধী আন্দোলনে নিহত মতিউরের নামে গুলিস্তান পার্কের নাম রাখা হয়েছিল৷ সেই শহীদ মতিউর পার্কেই গুলিস্তানের হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে পুরান ঢাকার লুপ্তপ্রায় সবুজের মধ্যে টিকে থাকা এই পার্কটি হারিয়ে হওয়ার আশঙ্কা করছেন ইতিহাসবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদেরা।
তবে এই পার্কে অস্থায়ী পুনর্বাসনের সুযোগ নিতে অনাগ্রহী অনেক হকার। তাঁদের আশঙ্কা, এখানে কোনো ক্রেতা যাবে না। আর স্থানীয় রাজনীতিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন।
ইতিহাসবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলেছেন, পুরান ঢাকার বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে কোনো মতে টিকে থাকা এই পার্কে হকারদের পুনর্বাসন করা হলে এর ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে৷ এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হকারদের অন্য কোনো স্থানে পুনর্বাসনের জন্য ডিএসসিসিকে আহ্বান জানান তাঁরা৷ তবে ডিএসসিসি বলছে, তারা আপাতত এই পার্কের একাংশে ওই পুনর্বাসন করবে৷ পরে পর্যায়ক্রমে তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার আগে গুলিস্তানের ওই এলাকা পল্টন মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে গভর্নর হাউস (বঙ্গভবন) ও পল্টন স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় পার্কটি সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত মতিউরের নামে ‘শহীদ মতিউর শিশু পার্ক’ নামকরণ করা হয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকে পার্কের পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে। এই পার্কে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসন করা হলে পার্কের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। ডিএসসিসিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা দরকার৷
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযান চালায় ডিএসসিসি। ওই দিন উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগের সঙ্গে হকার ও পাতাল মার্কেটের দোকানিদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তখন ফাঁকা গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই গত শনিবার নগর ভবনে গুলিস্তানসহ নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদে করণীয়বিষয়ক এই মতবিনিময় সভা করে ডিএসসিসি। এ সভায় শহীদ মতিউর শিশু পার্কের একাংশে হকারদের বসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ বর্তমানে পার্কটি গুলিস্তান পার্ক হিসেবে পরিচিত।
গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ৩ দশমিক ৫০ একর আয়তনের এই পার্কের চারপাশে দেয়ালঘেরা। ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ, মাঠে সবুজ ঘাস। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে কাজী বশির মিলনায়তন (মহানগর নাট্যমঞ্চ)। ভেতরে চারপাশে রয়েছে বেঞ্চ। এতে শুয়ে-বসে রয়েছে ভাসমান মানুষ। ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাগলের দল। সংসারও পেতেছেন অনেকে। পার্কের মাঝে পুকুর, এর পানিতে ভাসছে ময়লা-আবর্জনা। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে গোসল করছে। পার্কের মাঝে আরেকটি কৃত্রিম পুকুরও আবর্জনায় ভরা। মিলনায়তনের পশ্চিম পাশে দেয়াল ঘেঁষে আবর্জনার স্তূপ রয়েছে। এই অংশেই হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি৷
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, মহানগরের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও জলাধার আইন অনুযায়ী, গুলিস্তান পার্কে হকারদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। এই পদ্ধতিতে হকারদের সমস্যার সমাধান করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এভাবে ঢাকা শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ পার্ক বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, গুলিস্তানের হকার উচ্ছেদ একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা রাজনৈতিক ও পরিকল্পিতভাবেই সমাধান করতে হবে। আগে হকারদের চাহিদা মেটাতে গুলিস্তানে অপরিকল্পিতভাবে অনেক মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে পার্কটি সংস্কার করতে হবে।
ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সিটি জরিপে মহানগর নাট্যমঞ্চ ও গুলিস্তান পার্ক আলাদা উল্লেখ রয়েছে৷ ডিএসসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাট্যমঞ্চের আশপাশেই অস্থায়ীভাবে হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হবে, পার্কে নয়৷ এতে গুলিস্তানের সড়কে রোগীর গাড়ি চলাচল, শিশুদের স্কুলে যাতায়াতসহ পথচারীদের চলাচলে বাধার সৃষ্টি হবে না৷ তিনি বলেন, গুলিস্তানের ২ হাজার ৫০৬ জন হকারের একটি তালিকা তৈরি করেছে ডিএসসিসি। শিগগিরই গুলিস্তানে আবার বড় আকারের উচ্ছেদ চালানো হবে। ফুটপাত ও সড়কের এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও আর দখল হতে দেওয়া হবে না।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, গত ২৭ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল প্রায় চারটা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পাতাল সড়ক মার্কেট, গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স, ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর, ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ, সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স, ফুলবাড়িয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের চারপাশে পাঁচ শতাধিক অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করে ডিএসসিসি৷ এই উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ওই দিনই ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পাতাল সড়ক মার্কেটের দোকানি ও হকারদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ফাঁকা গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটে৷ গতকাল গুলিস্তানের উচ্ছেদ করা অংশে কোনো আলামত দেখা যায়নি। সড়ক ও ফুটপাত দখল করে হকাররা মালামাল নিয়ে বসেছেন। এ ছাড়া গোলাপশাহ মাজার এলাকা, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্স এলাকার ফুটপাতে আরও অনেক হকারকে বসতে দেখা গেছে।
সড়ক ও ফুটপাত ছেড়ে গুলিস্তান পার্কের ভেতরে যাবেন না বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির তালিকাভুক্ত হকার আমজাদ আলী, মাইনুদ্দিন মিয়া। তাঁরা বলেন, হকারদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্যই তালিকা করেছিল ডিএসসিসি। তাই স্থায়ী পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত ফুটপাত ছাড়বেন না। আর পার্কের ভেতরে ক্রেতারাও যাবে না। তবে ভিন্ন কথা বলেছেন হকার মজিবুর রহমান, আলাউদ্দিন ও মফিজুল ইসলাম। তাঁরা বলেন, গুলিস্তানের এই ফুটপাত থেকে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বড় অঙ্কের চাঁদা পান। তাঁরাই হকারদের শিশুপার্কের ভেতরে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন। হকাররা ভেতরে চলে গেলে তাঁরা আর চাঁদা তুলতে পারবেন না।
পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় পরিষদের সদস্য জাভেদ জাহান বলেন, ‘পুরান ঢাকার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় পার্ক৷ ছোটবেলায় এই পার্কে প্রায় প্রতিদিনই বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও আড্ডা দিতাম। তখন পুরো পার্কটি ছিল সবুজে ভরা। নাট্যমঞ্চটি নির্মাণের পর দিনে দিনে পার্কের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সকাল-বিকেল পার্কে ঘুরতে আসেন। পার্কে হকার না বসিয়ে মানুষের নিশ্বাস নেওয়ার জন্য তা সংস্কার করা দরকার।’