এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে

.
.

নিজের বয়স কত হলো, তা নিয়ে কি কিছু বলব? বাংলা প্রবাদ অনুসারে, উনসত্তরে বায়ু চড়া থাকে। বাহাত্তরের তো বেশ দুর্নামই আছে। আমি এই দুই বয়সের মাঝখানে কোনো রকমে আছি আরকি!
কিন্তু প্রথম আলো আঠারো বছর পূর্ণ করল আজ, ৪ নভেম্বর। প্রথম আলো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতেই পারে:
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
প্রথম আলো সব সময়ই তরুণ থাকতে চায়। তারুণ্যের কাগজ হতে চায়। প্রথম আলো অভিবাদন জানায় তারুণ্যকে। সব কালের, সব দেশের স্পর্ধিত তারুণ্যকে আমাদের সালাম, আমাদের শুভেচ্ছা।  
একদিন এই দেশের তারুণ্য বলে উঠেছিল, না, না, আমরা কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মানি না। একদিন এই দেশের তরুণেরা বড়দের পরামর্শ উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল বলেই আমরা পেয়েছি ভাষার অধিকার। রফিক-বরকত-সালামের পথ ধরে কত তরুণ—শহীদ মতিউর, শহীদ আসাদ থেকে একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর, শহীদ রুমি, শহীদ মেহেরুন্‌নেসা এবং আরও লাখ লাখ তরুণ নিজেকে উৎসর্গ করে আমাদের এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। শহীদ নূর হোসেন আর মিলনেরা এনে দিয়েছেন গণতন্ত্র।

আবার আজকের বাংলাদেশের তারুণ্য বড় হচ্ছে বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটে। একটা সময় ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাঠে নামার আগে লক্ষ্য হিসেবে বলতেন, পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করব। আর আজ? টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে তাঁরা প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকরা মাঠে নামেন জয়ের লক্ষ্যে। আর বিস্ময়-বালক মোস্তাফিজ আর মেহেদী তো কাঁপিয়ে দিচ্ছেন সারা বিশ্ব। আজকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দল ভারত, সিঙ্গাপুর, তাজিকিস্তানকে হারায় হেসে-খেলে। আজকে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের তরুণেরা ভারতের সামনে থাকে। তারা আন্তর্জাতিক নানা প্রতিযোগিতায় অনেক সাফল্য নিয়ে আসে।

বাংলাদেশ তারুণ্যেরই দেশ। এ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স ৩০-এর নিচে। তারা টগবগ করে ফুটছে। নিজের জন্য তারা কিছু করতে চায়, দেশকেও তারা এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সঙ্গে। তারা এভারেস্ট জয় করে ছুটছে সপ্তশৃঙ্গ জয় করে নিতে। তারা নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে পর্যটন—কত নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র তারা আবিষ্কার করছে। আবার দেশের জন্য যে কাজে, যে ভূমিকা রাখতে ডাকা হোক, তারা পিছিয়ে থাকছে না। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হাজার হাজার তরুণ নেমে আসেন রাজপথে।

তারুণ্য সব সময়ই নতুন কিছু করতে চায়। তারা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম। তারা বাঁধ ভেঙে ফেলতে চায়। সেইখানেই আমাদের আশা। আবার অন্ধকারের শক্তিরও লক্ষ্য এই তরুণেরাই। এঁদের বিপথগামী করতে পারলে তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করা সহজ হয়ে যায়।

তাই তো প্রথম আলো তারুণ্যের হয়ে, তারুণ্যের জন্য, তারুণ্যকে দিয়েই দেশের বুকে আলো জ্বালাতে চায়। অন্ধকারের বিরুদ্ধে ছড়ি কিংবা তরবারি ঘুরিয়ে কোনো লাভ নেই। অন্ধকার দূর করতে হয় আলো জ্বেলে। আমাদের সামনে আশার আলো এই বাংলাদেশের তারুণ্যই।

আমাদের কোটি কোটি তরুণপ্রাণ একেকটা দীপশিখা হয়ে জ্বলছে। আমরা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, বাংলাদেশের আনাচকানাচে, টেকনাফে কিংবা তেঁতুলিয়ায়, নড়াইলে কিংবা নরসিংদীতে হাজার হাজার আলোর শিখা জ্বলছে; যেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলে বসেছে আলোর মেলা, নক্ষত্রের মেলা; সেই আলো জ্বলছে আমাদের অগণিত তরুণপ্রাণে।

আমরা তাই অন্ধকারকে ভয় করি না। ভয় পাই না জঙ্গিবাদের দেশি কিংবা আন্তর্জাতিক চক্রান্তে। আমাদের তরুণেরা তো সদা জাগ্রত। তাঁরা আছেন। তাঁরা এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা পরিবর্তন রচনা করছেন। অপরিসীম উদ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে চলেছেন সামনে। জঙ্গিদের নিষ্ঠুর হামলার খবরে যখন সারা পৃথিবী স্তব্ধ, বাংলাদেশের ওপরে নেমে আসছিল উদ্বেগের অন্ধকার, তখনো তো আশার আলো জ্বালালেন আরেক তরুণ ফারাজ। আশার আলো জ্বালালেন অবিন্তা ও ইশরাত। তাঁরা পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মানুষ সব ধর্মের, সব জাতীয়তার মানুষের জন্য নিজের বন্ধুত্বের হাত সব সময় প্রসারিত করে রাখে। আশার আলো জ্বালালেন পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল, যিনি নিজ গ্রামে পরিচালনা করতেন প্রতিবন্ধীদের স্কুল—হলি আর্টিজান আক্রান্ত হওয়ার খবরে ছুটে গিয়ে প্রাণ দিলেন।

প্রথম আলোর আঠারোতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্‌যাপন মানে আমাদের কাছে বাংলাদেশের চির অপরাজেয় তারুণ্যের উদ্‌যাপন।

তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, ‌‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। আর আমরা চাই, প্রথম আলোর বয়স আঠারোয় যাক থেমে। প্রথম আলো নিশ্চয়ই একদিন শতবর্ষী হবে। কিন্তু তখনো তার তারুণ্যকে সে যেন ধরে রাখে। তার স্বপ্ন আর স্পৃহা যেন থাকে আঠারোর মতো। সে লক্ষ্যেই আমাদের সকল কার্যক্রম। কবি বলেছেন, ‌‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়’। আমরা যেন ভয় না পাই। কবি আরও বলেছেন, ‌‘আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে’। আমরা যেন কোনো আঘাতেই, কোনো বাধাতেই মাথা নত না করি। কবির ভাষায়, ‌‘এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়’। আমরাও যেন মাথা উঁচু করে থাকতে পারি সব সময়।

আমাদের বুকে সাহস তৈরি করে দেন বাংলাদেশসহ ২০১টি দেশ বা অঞ্চলের লাখ লাখ পাঠক। যাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন কত-না বিচিত্র আর বিস্ময়কর জায়গায়। আজকের দিনে আমরা তাঁদের কথাও ভাবছি।

নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তারুণ্যের দেশ বাংলাদেশ বিজয়ী হচ্ছে। প্রথম আলো সেই বাধার খবরও প্রচার করে, যাতে বাধা অপসারিত হয়। প্রথম আলো বাংলাদেশের বিজয়ের খবর ছড়িয়ে দেয় সারা পৃথিবীতে। প্রথম আলোর একটিই লক্ষ্য—সেটা হলো বাংলাদেশের জয়। আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এই প্রত্যাশার আনন্দ নিয়ে আমরা তাই বলছি, এ দেশের বুকে আঠারো নেমে আসুক।