ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১৭০০ মানুষ

.
.

ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার (মেগাসিটি) জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। এখানে ২০ বছরে মানুষ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এ জনসংখ্যার সঙ্গে প্রতিদিন নতুন ১ হাজার ৭০০ মানুষ যুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে বছরে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে। কিন্তু ঢাকা মেগাসিটিতে বাড়ছে ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। আর মেগাসিটির আশপাশে কোথাও কোথাও এই হার প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
যেসব নগরে এক কোটির বেশি মানুষ বাস করে, সেগুলোকে মেগাসিটি নাম দিয়েছে জাতিসংঘের বসতিবিষয়ক সংস্থা ইউএন হ্যাবিট্যাট। বিবিএস ও ইউএনএফপিএ বলছে, ঢাকা মেগাসিটি দেশের সবচেয়ে বড় পুঞ্জীভূত নগর এলাকা। চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকার দুটি, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর), দুটি বড় শহর (সাভার ও কেরানীগঞ্জ), চারটি সেনানিবাস (ঢাকা, মিরপুর, সাভার ও রাজেন্দ্রপুর) এবং কয়েকটি ছোট শহর ঢাকা মেগাসিটির অন্তর্ভুক্ত। দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ এই মেগাসিটিতে বাস করে।
ইউএনএফপিএ বাংলাদেশে নগরায়ণ ও অভিবাসনের ওপর একটি প্রতিবেদন (আরবানাইজেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ) প্রকাশ করেছে গত অক্টোবর মাসে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৬০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ভারতের কলকাতা শহরের জনসংখ্যার ১০ ভাগের ১ ভাগ। ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল কলকাতার জনসংখ্যার ৩ ভাগের ১ ভাগ। আর ২০০৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা কলকাতাকে ছাড়িয়ে যায়।
ওই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে ঢাকা ছিল কলকাতার হিন্টারল্যান্ড (পশ্চাদ্‌ভূমি)।
পাকিস্তান আমলে ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। আর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ঢাকা দেশের রাজধানী। রাজধানী হওয়ার পরপরই জনসংখ্যার চিত্র আমূল পাল্টে যায়। তিনি বলেন, ঢাকার অবস্থান দেশের প্রায় মাঝখানে। দক্ষিণের পটুয়াখালী বা উত্তরের ঠাকুরগাঁও থেকে সহজে মানুষ ঢাকায় আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পাঞ্চল, তৈরি পোশাকশিল্পের ৭৫ শতাংশ ঢাকা ও এর আশপাশে। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র এই শহর। উন্নত চিকিৎসার স্থল ঢাকা। উচ্চশিক্ষার মূল কেন্দ্রও এই ঢাকা। দেশের অন্যান্য অঞ্চল বা বিভাগীয় শহরগুলো অবহেলিত পড়ে আছে। সেখানে কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এসব কারণ ঢাকাকে জনবহুল করে তুলেছে।
ঢাকার ওপর কি চাপ বাড়তেই থাকবে? এই চাপ কমানোর জন্য সরকারের কি কোনো পরিকল্পনা নেই? এ প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারেক উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানোর পরিকল্পনা সরকারের আছে। সারা দেশের মানুষ যেন কাজ পায়, কাজের জন্য যেন ঢাকায় আসতে না হয়, সে জন্য ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, উপকূলের জেলা বিশেষ করে পটুয়াখালী ও বরিশাল থেকে মানুষ বেশি ঢাকায় আসছে। এ জন্য পায়রাবন্দর করা হচ্ছে। কাছাকাছি শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। ওই এলাকার মানুষের কাজের সংস্থান হবে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বহু মানুষকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মসূচি দরিদ্র মানুষের ঢাকায় আসা ঠেকাবে।
কত মানুষ ঢাকায়: ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্যকে ভিত্তি ধরে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জ্যেষ্ঠ গবেষক সুব্রত ভদ্র বলেছেন, বর্তমানে ঢাকা মেগাসিটির জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখের কিছু বেশি।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ঢাকা মেগাসিটি এলাকার জনসংখ্যা ছিল ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৬ লাখ ৭৩ হাজার। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪১ লাখ ৭২ হাজারে। বছরে ৬ লাখ ২৯ হাজারের মতো মানুষ বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মেগাসিটিতে দিনে মানুষ বাড়ছে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি।
ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর মেগাসিটিগুলোর মধ্যে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। ঢাকার কাছাকাছি জনঘনত্ব ভারতের মুম্বাইয়ে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩২ হাজার ৪০০। এরপর হংকংয়ে ২৬ হাজার ৪০০।
দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে। ঢাকা মেগাসিটিতে বাড়ছে ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে দেখা যায়, মেগাসিটির সব এলাকায় সমান হারে মানুষ বাড়ছে না। ঢাকা মহানগর এলাকায় (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) বছরে জনসংখ্যা বাড়ছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ হারে। কেরানীগঞ্জে বাড়ছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। নারায়ণগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় বাড়ছে যথাক্রমে ৪ দশমিক শূন্য ৫ ও ২ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে। গাজীপুর এলাকায় বাড়ছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। মেগাসিটি এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে মানুষ বাড়ছে সাভারে, ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ হারে।
অবশ্য ঢাকা মহানগর ও ঢাকা মেগাসিটির আয়তনের মধ্যে পার্থক্য আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কিছু তারতম্য দেখা যায়। ২০১৪ সালের নিপোর্টের এক পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছিল, ঢাকায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষের বসবাস। বছরে ৫ লাখ সাড়ে ১৭ হাজার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব তাতে পাওয়া যায়। তখন বলা হয়েছিল, প্রতিদিন ঢাকায় ১ হাজার ৪১৮ জন মানুষ বাড়ছে।
নতুন ঘনবসতি: অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব বলেন, অবিশ্বাস্যভাবে মানুষ বাড়ছে মেগাসিটির উত্তর ও পূর্ব দিকে। গত ১০ বছরের জনসংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কালিয়াকৈর এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এখানে বছরে ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে। এরপর গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় বাড়ছে ১৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। সোনারগাঁয়ে বৃদ্ধির হার প্রায় একই, ১৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। রূপগঞ্জ আর কালীগঞ্জে বাড়ছে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৭৮ ও ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে।

ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা মেগাসিটির আশপাশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৈপরীত্য আছে। কয়েকটি এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম (নবাবগঞ্জে শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ), আবার কয়েকটি এলাকায় জনসংখ্যা কমছে। যেমন দোহারে বছরে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে জনসংখ্যা কমছে। ঢাকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক কালিয়াকৈর, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক শ্রীপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক রূপগঞ্জ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সোনারগাঁয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এসব মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, এসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে জমির দাম কম। তুলনামূলক কম খরচে শিল্পকারখানা বা বসতবাড়ি করা যায়। এখানে কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কারণে নবাবগঞ্জ ও দোহার এলাকার চিত্রও পাল্টে যাবে।

>বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবা বিকেন্দ্রীকরণ, অভিবাসনের বিকল্প ব্যবস্থা, আঞ্চলিক শহরে শিল্প গড়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

করণীয় কী: ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা মেগাসিটির জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে, তবে জনসংখ্যাকে ব্যবস্থাপনাযোগ্য সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিবেদনে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিবাসনের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। আঞ্চলিক শহরে শিল্প গড়ার উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। যাতায়াত সহজ ও স্বল্প খরচে করার জন্য কমিউটার ট্রেনের ব্যবস্থা করা জরুরি।

প্রতিবেদনের সুপারিশ অংশে বলা হয়, দুঃখজনক হলো যে এ রকম সুপারিশ বিভিন্ন সময় করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নগরায়ণ ও সুশাসনবিষয়ক সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশে বাইপাস সড়কের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন সব মানুষকে ঢাকার ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে না হয়। দ্বিতীয়ত, সারা দেশে শিল্পায়নের উদ্যোগ নিতে হবে এবং শিল্পায়নকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে হবে। দেশের অন্য বড় শহরগুলোকে উপার্জন ও অর্থ ব্যয়ের স্বাধীনতা দিতে হবে, তাতে ঢাকার ওপর তাদের নির্ভরতা কমবে। আর ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাকে বসবাসযোগ্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।