কাল্পনিক তথ্যে ১২ বিদ্যালয় সরকারীকরণের সুপারিশ?

শর্ত পূরণ না হলেও সাতক্ষীরার ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণের জন্য উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে। কাল্পনিক তথ্যসহ এসব প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা সদর, তালা ও আশাশুনি উপজেলার ১৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার পূর্ব হাওয়ালখালী, আগরদাঁড়ি পশ্চিম, দ্যা পোল স্টার পৌর, উত্তর ধুলিহর, বালিথা পশ্চিমপাড়া ও বাঁশদাহ দক্ষিণপাড়া; তালার দক্ষিণ খেশরা, কলাগাছী পূর্বপাড়া ও মুকুন্দপুর দক্ষিণপাড়া এবং আশাশুনির উত্তর বলাবাড়িয়া, রুইয়ের বিল ও বড়দল শিববাড়ী—এই ১২টিবেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) যাচাই-কাছাই কমিটির আহ্বায়ক।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন বলেন, আবেদন করা বিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ তিনি পরিদর্শন করেছেন। এগুলোর মধ্যে শুধু সদরের উত্তর ধুলিহর, তালার কলাগাছী পূর্বপাড়া ও আশাশুনির বড়দল শিববাড়ী বেসরকারি বিদ্যালয় আংশিক শর্ত পূরণ করতে পেরেছে।

নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের জন্য ২০০৯-২০১২ সালে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম বিনা বেতনে চলমান ও কমপক্ষে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। বিদ্যালয়ের জন্য অবিচ্ছিন্ন ন্যূনতম ৩৩ শতক জমি থাকতে হবে। দুই কিলোমিটারের মধ্যে অন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে এবং উচ্চবিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার স্থাপিত ও পরিচালিত বিদ্যালয় জাতীয়করণের জন্য বিবেচ্য হবে না।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীতিমালা না মেনে যাচাই-বাছাই কমিটি কাল্পনিক তথ্য দিয়ে গত ২৯ আগস্ট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। বিদ্যালয়গুলোর সভার কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়েছে একই হাতের লেখায় ও সিদ্ধান্তগুলো প্রায় একই।

পূর্ব হাওয়ালখালী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নতুন টিনের ছাউনি ও বাঁশের চটা দিয়ে ঘিরে চারটি কক্ষ বানানো হয়েছে। সব কটি কক্ষে তালা মারা। তবে ভেতরে আটটি বেঞ্চ দেখা যায়। হাওয়ালখালী গ্রামের মতিয়ার শেখ, হাবিবুল ইসলাম ও মো. আইনুদ্দিন বলেন, দুই-তিন মাস আগে এখানে ঘর তৈরি করে বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রী নেই। মাঝেমধ্যে দুই ব্যক্তি এসে বসে থাকেন।

তবে যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৯৪ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুশতাক আহমদের প্রত্যয়নপত্রে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়টি ২০০৯ সাল থেকে হাওয়ালখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সফিউর রহমান বলেন, তাঁর বিদ্যালয় থেকে পূর্ব হাওয়ালখালী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রছাত্রী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। পূর্ব হাওয়ালখালী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহরাব হোসেন বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করেন।

বাঁশদাহ দক্ষিণপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ও ঘর দেখা যায়নি। বাকি বিদ্যালয়গুলোতে কিছু শিক্ষার্থী থাকলেও অন্যান্য চিত্র প্রায় একই ধরনের বলে জানা যায়।

সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুশতাক আহমদ জানান, তিনি সবগুলো বিদ্যালয় পরিদর্শন করেননি। সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত ফরম পূরণ ও সই করেছেন।

দ্যা পোল স্টার পৌর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারটি কক্ষ ও দেড় শতাধিক ছাত্রছাত্রী থাকলেও বিদ্যালয়টি পরিচালিত হয় পৌর কর্তৃপক্ষ ও দ্যা পোল স্টার পৌর হাইস্কুলের সঙ্গে।

দ্যা পোল স্টার পৌর, বাঁশদাহ দক্ষিণপাড়া ও বালিথা পশ্চিমপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে প্রয়োজনীয় জমির দলিল জমা দিয়েছে। কিন্তু সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দলিলে উল্লেখিত জমি এসব বিদ্যালয়ের নামে নয়। বিদ্যালয় তিনটির প্রধান শিক্ষকগণ এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি।

সদরের ইউএনও শাহ আবদুল সাদী বিদেশে প্রশিক্ষণে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আশাশুনির সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, তিনি দুটি বিদ্যালয়যাচাই-বাছাই শেষে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছেন। এর মধ্যে মানবিক কারণে উত্তর বলাবাড়িয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। রুইয়ের বিল বিদ্যালয়টি নীতিমালার আংশিক শর্ত পূরণ করেছে।

আশাশুনির ইউএনও সুষমা সুলতানা জানান, তাঁর কাছে বড়দলের নামে দুটি বিদ্যালয়ের নাম এসেছে। এর মধ্যে কোনটি ঠিক তা তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।

তালার সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রাজমনি বলেন, তিনি তিনটি বিদ্যালয়ের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছেন। এর মধ্যে কলাগাছী পূর্বপাড়া বিদ্যালয়টি নীতিমালার আলোকে দেওয়া হয়েছে। অন্য দুটি কমিটির সব সদস্যের সিদ্ধান্তে দেওয়া হয়েছে।

তালার ইউএনও ফরিদ হাসান বলেন, উপজেলার পাঁচটি বিদ্যালয়ের একটিও সরকারীকরণের নীতিমালা পূরণ করতে পারেনি। তিনি যোগদানের আগেই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়ের যাচাই-বাছাই প্রতিবেদন নিয়ে নানা ধরনের কথা রয়েছে। জেলা কমিটি আবার বিশেষ দল গঠন করে এসব তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবে।