রোহিঙ্গাদের মানবেতর ও প্রায় বন্দিজীবন

বাঁশের বেড়া-গোলপাতার ছাউনির ১২ ফুট লম্বা ঝুপড়িঘর। এই ঘরেই গাদাগাদি করে থাকছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গৃহহীন ২১ রোহিঙ্গা গৃহবধূ। বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছর। তাঁদের সঙ্গে আছে ২৩ শিশু। শিশুদের কান্নাকাটি, হইচই আর ঝগড়ায় ঘরটিতে টেকা দায়।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং অনিবন্ধিত শিবিরের একটি ঘরে ঢুকে দেখা যায় এই ৪৪ নারী-শিশুকে। কথা বলে জানা গেল, তারা গত দুই দিনে বাংলাদেশে ঢুকে এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারের পুরুষ ও বড় ছেলেরা আছে মসজিদে।

পাহাড়-জঙ্গলঘেরা গ্রাম কুতুপালংয়ের এই শিবিরের অনেক ঝুপড়িতেই এখন সদ্য প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের এমন গাদাগাদি অবস্থান। শিবিরের লোকজন বলেছেন, গত ১৫ দিনে এই শিবিরে এসেছে অন্তত নয় হাজার রোহিঙ্গা। তাদের হাতে টাকা নেই, খাবার নেই। খাবার জোটাতে কাজ করতেও বাইরে যেতে পারছে না। ফলে একপ্রকার বন্দী ও মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।

শিবিরে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেখলেই দৌড়ে আসেন রোহিঙ্গারা। নাম লিখে নেওয়ার অনুরোধ করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়েছে, এ জন্য তাঁরা কৃতজ্ঞ। এখন বাঁচার জন্য ত্রাণ, পরনের কাপড় চান। নইলে কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যাবে।

বিভিন্ন সূত্র বলেছে, গতকাল টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রায় আড়াই হাজার নতুন রোহিঙ্গা ঢুকেছে।

কুতুপালংয়ের একটি পাহাড়ে দুই যুগ ধরে বাস করছে নিবন্ধিত প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। এর আশপাশের পাহাড়-জঙ্গলে কয়েক হাজার ঝুপড়িঘরে বাস করছে অনিবন্ধিত অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ঘরে উঠছে নতুন আসা রোহিঙ্গারা।

৪৪ নারী-শিশু যে ঘরে রয়েছে, তার মালিক আবুল ফয়েজ (৩৯)। তাঁর বাড়িও রাখাইনের মংডুতে। চার বছর আগে তিনি সপরিবারে পালিয়ে আসেন। বন বিভাগের ছোট জমিতে ১২ ফুট লম্বা ঘর তৈরি করে বাস করছেন। তিনি বলেন, গত সোমবার তাঁর ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন আট পরিবারের ৩১ জনকে। গতকাল মঙ্গলবার এসেছে চার পরিবারের ২৩ জন। ঘরে জায়গা না হওয়ায় পুরুষ ও বড় ছেলেদের পাশের একটি মসজিদে রাখা হয়েছে। পাশের আরেক ঘরে থাকছে তাঁর পরিবার।

রাখাইনের নাইছাপ্রু গ্রামের আয়েশা বেগম (২০) বলেন, তীব্র শীতে সাত মাসের বাচ্চা নিয়ে খুবই কষ্ট হচ্ছে। গাদাগাদি আর হইচইয়ের জন্য ঘুমানো যায় না। চার দিন ধরে কারও গোসল নেই। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দূরে জঙ্গলে যেতে হয়। এ রকম নরকযন্ত্রণা কত দিন পোহাতে হবে কে জানে।

খেয়ারিপাড়ার তৈয়বা খাতুন (৪০) বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে কয়েক হাজার টাকা এনেছিলেন। গত তিন দিনে সব টাকা শেষ। এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে চলবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। আয়রোজগারের জন্য পুরুষেরা শিবির ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতে পারছেন না। সড়কে আছে পুলিশ ও বিজিবির পাহারা।

এই শিবিরের এ-৩ ব্লকের রোহিঙ্গা মো. নূরের ১৮ ফুটের একটি ঘরে থাকছে ২৫ নারীসহ আরও ৫১ রোহিঙ্গা। তিনি বলেন, প্রতিদিন এই শিবিরে রোহিঙ্গাদের আগমন বাড়ছে। কিন্তু থাকার জায়গা নেই। কেউ কেউ ঘরে থাকতে দিলেও খাবার নিয়ে চলছে চরম সংকট। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক দিনে এই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় নয় হাজার রোহিঙ্গা। তাদের অনেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে মিশে যাওয়ার আগেই অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পুনর্বাসন দরকার। না হলে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর আগেও তিন লাখ রোহিঙ্গা সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে।

আরও রোহিঙ্গা এসেছে: রাখাইন থেকে পালিয়ে গতকাল আরও প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফ ও উখিয়ায় ঢুকেছে। ঢুকে পড়া রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ গতকালও রাখাইনের তিনটি রোহিঙ্গা গ্রামে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। ওই তিন গ্রামের উচ্ছেদ হওয়া কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মংডু শহরের কয়েকটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

গতকাল কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, গত দুই দিনে এই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা।

দুপুরে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে গেলে শিবিরের রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, গতকালও ঢুকেছে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা। এর আগে ঢুকেছে প্রায় তিন হাজার। আরও অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়-জঙ্গল ও লোকজনের ঘরবাড়িতে অবস্থান নিয়েছে। বিজিবি ও পুলিশের জন্য তারা শিবিরে আসতে পারছে না।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী বলেন, নাফ নদী দিয়ে টেকনাফে প্রবেশের সময় বিজিবি ভোরে ছয়টি নৌকাসহ শতাধিক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, সৈকত দিয়ে কক্সবাজার শহরে পালানোর সময় বিজিবি সদস্যরা রেজুখাল থেকে গতকাল ৩৭ রোহিঙ্গাকে ধরে ফেরত পাঠিয়েছেন। এর আগে ফেরত পাঠানো হয় ৪৫৩ জনকে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র বলেছে, সোমবার দিবাগত রাত একটা থেকে গতকাল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্গম স্থান দিয়ে টেকনাফে প্রায় দেড় হাজার এবং উখিয়ায় এক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে। সীমান্ত এলাকার ঘরবাড়িতেও লুকিয়ে আছে শত শত রোহিঙ্গা।

দুপুরে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা শীতের মধ্যে চরম কষ্টে আছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, দ্বীপের কয়েকটি গ্রামে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা আছে। তারা কখন এসেছে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

সকালে টেকনাফের জালিয়ারদিয়া, লালদিয়া ও জাদিমুরা বরাবর নাফ নদীর ওপাড়ে লোকবোঝাই কয়েকটি নৌকা ভাসতে দেখা গেছে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. আবদুল মজিদ বলেন, দালালের মাধ্যমেই রোহিঙ্গারা টেকনাফে ঢুকছে। ইতিমধ্যে পুলিশ ও বিজিবি ১২ দালালকে আটক করেছে।