রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন সেটাই হবে

গণভবনে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: বাসস
গণভবনে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপির চেয়ারপারসনের দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে করণীয় ঠিক করার ভার ছেড়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির ওপর।

গতকাল শনিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন-সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওনার প্রস্তাব উনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে বলুক। এটা রাষ্ট্রপতি ভালো বুঝবেন, উনি কী পদক্ষেপ নেবেন। রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন সেটাই হবে। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর হাঙ্গেরি সফর সম্পর্কে জাতিকে অবহিত করার জন্য এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকেরা নানা প্রশ্ন করেন এবং তিনি এর জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজে ত্রুটি থেকে শুরু করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তন, তিস্তার পানি চুক্তি, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ অনেক বিষয় উঠে আসে প্রশ্নোত্তর পর্বে।

খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে আপনারা এর মাথা বা লেজের হদিস পেয়েছেন কি না, আমি জানি না। তিনি নির্বাচন করেননি, একটা দল হিসেবে বা দলের প্রধান হিসেবে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত থেকেছিলেন। এখন এত দিন পর ওনার টনক নড়ল। এরপর উনি মানুষ খুন করে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত করার আন্দোলন করলেন। যেকোনো প্রস্তাব দেওয়ার আগে তাঁর তো জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।’

হত্যাকাণ্ড থেকে কোনো সম্প্রদায়ই রেহাই পাননি জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সাধারণ মানুষ, বাসের চালক, হেলপার, রেল, লঞ্চ, কোথায় না আঘাত করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পুড়িয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারকে মেরেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ২০ জন সদস্যকে হত্যা করেছে। আগে সেই জবাবটা জাতির কাছে দিক। তারপর প্রস্তাব নিয়ে কথা হবে।

খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান মারা যাওয়ার পর সমবেদনা জানাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে দেখতে গেলাম, ঢুকতে দেওয়া হলো না। বড় গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকতে না দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো। বললাম গাড়ি রেখে ছোট গেট দিয়েই যাব। নামলামও। তারপর ছোট গেটও বন্ধ করে দেওয়া হলো। এ ধরনের অভদ্র যারা, তারা কী প্রস্তাব দিল না দিল, ওটা নিয়ে আমার মতামত চান কেন আপনারা? এ ধরনের ছোটলোকি যারা করে, অভদ্রতা যারা করে তাদের কোনো মতামতের ওপর মতামত দেওয়ার অভিপ্রায় আমার নেই। যারা খুনি, খুনিদের কথার আবার কিসের জবাব দেব। তার প্রস্তাব নিয়ে এত তোলপাড় করার কী আছে, আমি তো বুঝি না।’

বিএনপির কখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া, আবার কখনো বর্জনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা জিতেছিল। তখন নির্বাচন কমিশন নিয়ে অভিযোগ তুলল না কেন? আজকে একটা নির্বাচনে অংশ নেবে, জিতলে ভালো, হারলে সব খারাপ।

খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তিনি (খালেদা) একেবারে সেই বাহাত্তরের পর থেকে যত পার্টি, ফ্রিডম পার্টি থেকে শুরু করে খুনিদের দল, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী সবাইকে নিয়েই কথা বলতে চান। ওনার ভাব তো বোঝাই গেল উনি কী চাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য মূল সংকটকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এ মুহূর্তে সবার চাওয়া হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সে জন্য একটি সাহসী, যোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দরকার। প্রধানমন্ত্রী সেদিকে না গিয়ে অযথা অতীতচারিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন রাষ্ট্রপতির কথা। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব তো বটেই। কিন্তু তিনি কি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীরও তো দায়িত্ব রয়েছে।

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্য যেকোনো সাংবিধানিক পদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। অতএব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সমর্থন থাকার কথা আগে জানিয়ে দিতেও পারেন।

এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, বিএনপি একটি বড় এবং বিপুল জনসমর্থন থাকা রাজনৈতিক দল। সেই দলের দেওয়া প্রস্তাব সরকার গুরুত্বহীনভাবে নিয়েছে, এটা মনে হয় না। উনি (প্রধানমন্ত্রী) অতটা কাঁচা রাজনীতিবিদও নন। তাই জনসমক্ষে যা-ই বলুন না কেন, উনি গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছেন বলে মনে হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সংসদ ভবন এলাকা থেকে স্থাপনা সরানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নকশাপ্রণেতাদের টাকা পাওনা ছিল। টাকা দেওয়া হয়েছে। একটি দল পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই আই কানের মূল নকশার চারটি সেট নিয়ে আসা হয়েছে। এ থেকে স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রদের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে। অনেক পর্যটক আসেন দেখতে। মূল নকশা সংসদে, জাতীয় আর্কাইভে ও স্থাপত্য অধিদপ্তরে রাখা হবে।

পাকিস্তান আমলে কীভাবে সংসদ ভবন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সে সময় এই জায়গার অবস্থা কী ছিল তা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। জিয়ার কবর অপসারণের খবর সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।’ তিনি আরও বলেন, সংসদ ভবনের বেড়া ও স্পিকারের বাড়ি নির্মাণের সময় অনেকেই হইচই করেন। কিন্তু সার্বিকভাবে যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। লেকটা কিন্তু অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এটা একটা স্টারের মতো। নকশার একটা তাৎপর্য আছে।

এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, বিভিন্ন টক শোতে অনেকেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখতে পান। আপনি পান কি না। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এখন কোথায় আছি? এখন মধ্যপথে আছি? এখন আর মধ্য নেই, মধ্য ক্রস করে ফেলেছি। তিন বছর হয়ে যাচ্ছে। মধ্যবর্তী যদি বলেও থাকেন, সেটা পরবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে বলেছেন। স্বপ্ন দেখা ভালো।’

বিমানে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো কিছু—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করেন কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে, ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, বুঝেছে দুর্বৃত্ত।’ এরপর তিনি বলেন, ‘এটা একটা যান্ত্রিক দুর্যোগ ছিল, আর কিছু না। হয়তো যান্ত্রিক কিছু একটা হয়েছে। সহিসালামতে বেঁচে আছি, আপনাদের সামনে আছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। অ্যাকসিডেন্ট তো হয়ই। ব্রাজিলে কী হলো। ফুটবল প্লেয়ারসহ প্লেন ক্রাশ করল। অ্যাকসিডেন্ট অ্যাকসিডেন্টই। এটাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে অ্যাকসিডেন্ট যান্ত্রিক ত্রুটিতেও হতে পারে, আবার মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও হতে পারে।’

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের জন্য আলাদা উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নতুন এয়ারক্রাফট কেনার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দেশের জন্য কিনেছি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর জন্য আলাদা এয়ারক্রাফট কেনা বিলাসিতা। এটা করার মতো সময় আমাদের আসেনি। গরিবের ঘোড়ারোগ না হওয়াই ভালো। ঘোড়াকে খাওয়াতে, লালনপালন করতে যথেষ্ট খরচ লাগে। এটার প্রয়োজন নেই, আমি চাইও না।’

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছে। বিজিবি সতর্ক আছে। কিছু কিছু মানুষ এলে মানবিক দিক বিবেচনা করে আশ্রয় না দিয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী, নয়জনকে হত্যা করল, তারা কোথায় আছে? কী অবস্থায় আছে ধরে দেওয়া উচিত। তাদের জন্য হাজার হাজার মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা যদি আমাদের এদিকে এসে থাকে আমি ইন্টেলিজেন্সকে খবর দিয়েছি তাদের খুঁজে বের করার। কেউ যদি শেল্টার নিতে আসে দেব না, তাদের মিয়ানমারের হাতে তুলে দেব।’ রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্টের বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আরও সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসতে পারেন—এমন আভাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি নির্বাচিত। ক্ষমতা গ্রহণের পর কী বলেন দেখতে হবে। এখানে অনেক বৈশ্বিক রাজনীতি আছে। এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সময় আসেনি।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, কপ-১৫ জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে আসলে প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। সহযোগিতা কমই পাওয়া যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তাদের উন্নয়ন হয়ে গেছে। এখন অন্যদের পাত্তা দিতে চায় না। জলবায়ু সম্মেলনের উদ্যোক্তা জাতিসংঘ। তাই জাতিসংঘের মাধ্যমে চাপ অব্যাহত রাখা হবে। কারও কাছে চাওয়ার আগে নিজের ব্যবস্থা নিজে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ১৩৫টি পদক্ষেপ নিয়েছে। নিজস্ব অর্থে জলবায়ু তহবিল গঠন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কিছু দেশ সামান্য সহযোগিতা দেয়। বড় দেশ বলতে যাদের বোঝায় তারা হাত খোলে না।