গুলি আর বিস্ফোরণের মুখে ১৭ বছরের গেরিলা

‘মা, প্রচণ্ড গোলাগুলি হইব, ঘরের বাইর হইবা না।’

এই বলে গভীর রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান ১৭ বছরের এক তরুণ। ভোরবেলা ঘরে ঢুকে দেখেন, মা তখনো সেজদায়।
‘মা, মা।’ ফিসফিস করে মাকে ডাকেন ছেলে।
‘বাবা, আইছস? আমি তো তুই যাওনের পরই সেজদায় বইছি, আর অহন তরি উঠি নাইক্কা।’
তরুণের নাম আলীজান। বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার আগানগর তাঁর ঠিকানা। উজান ঠেলে জীবনের বইঠা বেয়ে আজ এত দূর পর্যন্ত এসেছেন। চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েও নিজেকে শুনিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের সঞ্জীবনী, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি ভয় পাব ক্যান?’
৬৩ বছরের আলীজান বলছিলেন নিজের কথা, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এক খাবারের দোকানে বসে, ১০ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ৯টায়। গায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি মলিন টি-শার্ট। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। তবে ঋজু তাঁর কণ্ঠ। বলার ভঙ্গিতে ঠিকরে বেরোয় প্রবল আত্মপ্রত্যয়।

টিকিট চেক করছেন মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। কেরানীগঞ্জের আগানগরের ‘নিউ গুলশান’ সিনেমা হলে টিকিট চেকারের চাকরি করেন তিনি। ছবি: জাহিদুল করিম
টিকিট চেক করছেন মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। কেরানীগঞ্জের আগানগরের ‘নিউ গুলশান’ সিনেমা হলে টিকিট চেকারের চাকরি করেন তিনি। ছবি: জাহিদুল করিম

পাঁচ বোন, তিন ভাইয়ের সংসারে সবার বড় আলীজান। বাবা আরজু মিয়া ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন রেঙ্গুন আর সিঙ্গাপুরে। ছেলের ভাষায়, ‘বাবা এমন লাঠি ঘোরাইতে পারতেন, গুলি ফেল খাইয়া যাইত।’
ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছেন আলীজান। অল্প বয়সেই নামতে হয়েছিল জীবনযুদ্ধে। ১৯৭১-এ সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে কুলির সর্দারি করতেন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারবাগ ও পিলখানা আক্রমণ করল। রাজারবাগ থেকে শত শত পুলিশ আর পিলখানা থেকে শত শত ইপিআর (পরে বিডিআর, এখন বিজিবি) সদস্য সাঁতরে নদী পার হয়ে ওপারে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা কেরানীগঞ্জ থেইকা দেখতাছি, ইংলিশ রোডে আগুন জ্বলতাছে।’
আলীজান স্মরণ করেন, ‘২৬ মার্চ সকালবেলা মন্টু ভাই, খসরু ভাই (তখনকার ছাত্রনেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু ও আমীর খসরু) আসলেন। শত শত মানুষ। তাঁরা কেরানীগঞ্জ থানা ও আগানগর কেচি সাহা এলাকার আনসার ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়েছিলেন। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মোস্তফা মহসীনের বাড়ির সামনে নেকরোজবাগ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হতো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা রাত বুড়িগঙ্গায় টহল দিত। ওরা ছিল ওপারে (ঢাকা), তাঁরা এপারে (কেরানীগঞ্জ)।’

কেরানীগঞ্জের আগানগরের ‘নিউ গুলশান’ সিনেমা হলের করিডরে মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম
কেরানীগঞ্জের আগানগরের ‘নিউ গুলশান’ সিনেমা হলের করিডরে মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম

মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা মহানগর ও জেলা কমান্ডার মোস্তফা মহসীন মন্টুর সঙ্গে কথা হলো মুঠোফোনে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আলীজানকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। কেরানীগঞ্জে বাঘৈর ক্যাম্পে তিনি যুদ্ধ করেন। ছিলেন অসম্ভব সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার এ অঞ্চলটি ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। কেরানীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল ৮ থেকে ১০টি। একটি ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম। তাঁর পরিচয় ছিল নুরুল ইসলাম কমান্ডার নামে। এই ক্যাম্পের গেরিলাযোদ্ধা ছিলেন আলীজান। মুক্তিবার্তা নম্বর ০১০২০৪০৬৩৭। আর তাঁদের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন সুলতানউদ্দিন আহমেদ।
এপ্রিল মাসের ২ তারিখ ভোর চারটায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কেরানীগঞ্জ আক্রমণ করে। তারা এসে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘নেকরোজবাগ কাঁহা হ্যায়’, ‘থানা কিধার হ্যায়’, ‘মালাউনপাড়া কিধার হ্যায়’। মনু বেপারীর ঢালের ওপরই ওরা ৪০০-৫০০ মানুষ মেরে ফেলে রাখে। পুরো অভিযানে পাঁচ হাজার নিরপরাধ লোককে হত্যা করে। বহু হিন্দুপাড়া জ্বালিয়ে দেয়। আলীজান বলেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে পারেননি। কারণ অস্ত্র খুবই কম। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে কেরানীগঞ্জের শেষ মাথায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নেন। এরপর অনেকে চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। আলীজান যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল আগানগরের বুড়িগঙ্গার তীরে বাবুবাজার সেতুর নিচে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবিতে ওই জায়গাটিই দেখাচ্ছেন তিনি। ছবি: জাহিদুল করিম
১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল আগানগরের বুড়িগঙ্গার তীরে বাবুবাজার সেতুর নিচে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবিতে ওই জায়গাটিই দেখাচ্ছেন তিনি। ছবি: জাহিদুল করিম

নুরুল ইসলাম ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের বাঘৈরে ক্যাম্প করেন। আলীজান যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে। নেন গেরিলা প্রশিক্ষণ।
ঢাকায় একটি বিমানযুদ্ধের কথা উল্লেখ করলেন আলীজান, তবে তারিখ মনে করতে পারলেন না (স্থানীয় অনেক মুক্তিযোদ্ধার তথ্যমতে, তারিখটি ছিল ৯ ডিসেম্বর)। ভারতের বিমানবাহিনী ঢাকা এয়ারপোর্টে আক্রমণ করে। পাল্টাপাল্টি গুলি হয়। আকাশে আগুন ধরে যায়। ভারতের বিমানটি পড়ে জিঞ্জিরার এক বাড়িতে। আর পাকিস্তানের বিমানটি পড়ে বিল কাঠুরিয়ার খেতে। এ সময় প্যারাস্যুট দিয়ে নামতে পারেন ভারতীয় দুই পাইলট। রাজাকারেরা ‘জয় বাংলা’ বলে বিভ্রান্ত করে পাইলটদের ছিনিয়ে নেয়। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন জিঞ্জিরা পিএম পাইলট হাইস্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করার।
নুরুল ইসলাম কমান্ডারের নেতৃত্বে শেষ রাতে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একটা মাইন পাতা হয় রাজাকার ক্যাম্পের দেয়ালে। খানিক পরই বিস্ফোরিত হবে মাইন। উড়ে যাবে রাজাকার ক্যাম্প। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু মাইনটি বিস্ফোরণ হলো না। উপায় না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ করলেন।

স্থানীয় মানুষজনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করছেন আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম
স্থানীয় মানুষজনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করছেন আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম

সে রাতে ফিরে যান আলীজান। বলেন, ‘মায়ের পায়ে সালাম করে রওনা হই। আমার হাতে ছিল গ্রেনেড। আমি কমান্ডারকে কভার দিই। আমরা গুলি করি, গ্রেনেড ছুঁড়ি। কিন্তু ওদের দিক থেকে কোনো গুলি আসছিল না। পরে জানতে পারি ওরা আগেই সটকে পড়েছিল।’
রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবার কেরানীগঞ্জে অভিযান চালায়। রাজাকারদের সহায়তায় ঘরে ঘরে গিয়ে অসংখ্য তরুণকে হত্যা করে ফেলে দেয় বুড়িগঙ্গায়। ক্যাম্পে পালিয়ে থেকে বেঁচে যান আলীজান।
এরপর আরেকটি অভিযানে বিদ্যুতের পাওয়ার হাউসের টাওয়ার উড়িয়ে দেন আলীজান। এ ছাড়া আরও কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে গেরিলাযুদ্ধ রাতে হওয়ায় দিনের বেলায় কোনো কোনো দিন সদরঘাটে কুলির সর্দারিও করতে পেরেছেন তিনি।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করতে পারেন আলীজান। সাইকেল চালিয়ে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। দেয়ালে গুলির ক্ষতচিহ্ন। হাজার হাজার ঢাকাবাসী। ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। আরেক দিকে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানিরা সেনারা। তাদের পরাজিত মাথা নিচু।

আলীজান এখন
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই অস্ত্র জমা দিয়ে আলীজান পেয়েছিলেন এম এ জি ওসমানী ও মেজর হায়দায়ের স্বাক্ষর করা একটি সনদ, যেটি ছিল দেশরক্ষা বিভাগ থেকে দেওয়া ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’।
আলীজান ফিরে গেলেন সে দিনগুলোতে। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বেকার হয়ে পড়েন। চারদিকে অস্থিরতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু গঠিত রক্ষীবাহিনীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু যাননি। তাঁর কথায়, ‘আব্বা একদিন বললেন, “যা কামে লাইগা পড়।” দুইখান নৌকা কিনে দিলেন। একখান ভাড়া দিলাম। একখান নিজে চালাইতাম। হইলাম মাঝি। বিয়া করলাম। মাঝি বইলা ছাড়ায়া দিল।’

অস্ত্র চালনার ভঙ্গিতে কেরানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম
অস্ত্র চালনার ভঙ্গিতে কেরানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আলীজান। ছবি: জাহিদুল করিম

আলীজানের চোখে-মুখে এক ধরনের দুঃখ খেলা করে। আবার বলতে শুরু করেন তিনি। এরপর বাড়িতে ছোট একটি কারখানা দিয়ে স্প্রিং বানানো শুরু করেন। কিন্তু লস হয়।
কীভাবে চলবে সংসার? বাড়ির বড় ছেলে তিনি। এতগুলো ভাইবোন। ১৯৭৫ সালের দিকে আগানগরে একটি সিনেমা হল চালু হয়। ‘নিউ গুলশান’ নামে সেই সিনেমা হলে চাকরি নেন। বেতন ৭০০ টাকা। তার কাজ টিকিটের একটি অংশ ছিঁড়ে নিজের কাছে রাখা। এখনো এই চাকরিই করছেন তিনি। বেতন বেড়ে হয়েছে চার হাজার টাকা। এর সঙ্গে ভাতা পান দশ হাজার টাকা। জানুয়ারি থেকে ভাতা আরেকটু বাড়বে এ রকম আশা পেয়েছেন।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের সনদ জমির দলিলের ফাইলে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। মূল্যায়ন ছিল না। ১৯৯৬ সালে মুক্তিবার্তায় নাম ওঠে তাঁর। ভাতা পাওয়া শুরু করেন ২০০৭ সাল থেকে। এর আগেও একবার ভাতা পাওয়ার কথা হয়েছিল।
ছেলে সিরাজুলও সিনেমা হলে চাকরি করেন। মেয়ে জেসমিনের বিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিকের ছোট ভাই মোহাম্মদ সফিকের সঙ্গে। ছেলে ও মেয়ের ঘরে নাতি-নাতনি মিলে পাঁচজন।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পৌনে ১ শতাংশ জমিই তাঁর সম্বল। তিনটি কক্ষ বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন ছেলেকে।
কিছুটা হতাশ কণ্ঠে আলীজানের উচ্চারণ, ‘দেশ স্বাধীন করলাম, কী হইলো। দেশ তো লুটেপুটে খেয়ে গেল।’ ৪৫ বছরে দেশের যতটা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, তার কিছুই তো হয়নি। তাঁর কথা, ‘এ দেশে গরিব থাকার কথা না। বেকার থাকার কথা না।’ কেরানীগঞ্জের আঞ্চলিক প্রবাদে বললেন, ‘কী করলাম কী হইল, ছাতু মাখলাম, ময়লা হইল।’
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলীজানকে আর ধরে রাখা গেল না। ১২টা বাজতে চলল। সিনেমার শো শুরু হবে। হলে ডিউটি আছে তো!