'এতিম ছেলেগুলোকে নিয়ে কোথায় যাব'

দোহারে পদ্মার ভাঙনের মুখে বাহ্রা হাবিল উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ভবন। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
দোহারে পদ্মার ভাঙনের মুখে বাহ্রা হাবিল উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ভবন। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবি l প্রথম আলো

‘এখন শীতকাল। হেরপরও ভাঙছে পদ্মার পাড়। দেহেন, ওই হানে মসজিদ আছিল। গেল বর্ষায় ভাইঙ্গা গেছেগা। এই যে রান্নাঘরের কাছে ফাটল দেখতেছেন, যেকোনো সময় ধপাস। মাদ্রাসাটা আছে ভাঙনের ঝুঁকিতে। এটি নদীতে ভেঙে পড়লে এতিমদের নিয়ে কোথায় যাব আল্লাহ পাক ছাড়া কেউ জানে না।’
গত বৃহস্পতিবার এভাবেই কথাগুলো বলেন হাফেজ মো. নজরুল ইসলাম। তিনি ঢাকার দোহার উপজেলার বাহ্রা জা’মিয়া আশ্রাফিয়া মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে স্থাপিত এই মাদ্রাসায় বর্তমানে ৩০ জন এতিম ছেলে আছে। শিক্ষক তিনজন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের সালথায়। তিন বছর ধরে এখানে পড়ান। থাকা-খাওয়া সব এখানেই। বর্ষাকালে তিনি দেখেছেন পদ্মার রুদ্রমূর্তি। প্রবল স্রোত পাক খেয়ে খেয়ে যায়। সামনে ঘরবাড়ি, মসজিদ-স্কুল যা পায়, ছাতুর মতো গুঁড়া করে দেয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দোহারে গেল বর্ষায় পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০৫টি পরিবার। কিন্তু স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার দাবি, এ সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। বর্ষা মৌসুমের পরবর্তী ভাঙনের কোনো হিসাব উপজেলা পরিষদে নেই। চলতি বছর বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের। এর মধ্যে নয়াবাড়ীর ২৮৪টি পরিবার, সুতারপাড়ার ১৯৫টি, নারিশার ১৫৯টি, মুকসুদপুরের ২৬টি ও বিলাসপুরের ৯০টি পরিবার রয়েছে।
বাহ্রা গ্রামের শেখ হেলালসহ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এ এলাকায় তাঁদের অন্তত চার পুরুষের বসবাস। এর আগে কখনো পদ্মার এমন ভয়ংকর ভাঙন দেখা যায়নি। কয়েক বছর আগে মাঝনদীতে চর পড়ে ভরাট হয়ে যায়। এপারে ভাঙন শুরু হয়। দেখা গেল, একটি দোতলা পাকা বাড়ি ভেঙে পড়ছে। শত শত লোক জড়ো হয়েছে এ দৃশ্য দেখতে। আবার দেখা যায়, এক রাতে কয়েকটি ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
একই গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া বেগম (৬৫) বলেন, আটনি গ্রামে তাঁর স্বামীর পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় সবই গেছে পদ্মার পেটে। দুই কাঠা জায়গায় দুটি টিনশেডের ঘর বানিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিন মাস আগে পাড় ভেঙে একটি পদ্মায় তলিয়ে যায়।
দোয়াইর গ্রামের বাসিন্দা শহীদ মিয়া বলেন, নয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১২টি মৌজার মধ্যে ১০টি মৌজার জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন ভাঙন রোধে ব্লক নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এ কাজ শেষ হওয়ার আগেই আরও কিছু ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ বলেন, নদীর বালু মিশিয়ে নিম্নমানের ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। পরিমাণে সিমেন্ট কম দেওয়া হচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই।
গত শনিবার বাহ্রা ঘাট থেকে উত্তর দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার তীর ঘুরে দেখা যায়, অনেক অংশে পাড় উঁচু। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ফাটল রয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, ভেঙে পড়ার আগে এমন ফাটল ধরে।
দোহার ছাড়াও চলতি বছর নবাবগঞ্জ উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়েছে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ধুনসুড়া, তাজিমনগর ও সুতারপুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সোনাবাজু বেড়িবাঁধসংলগ্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ পরিবার। লাকি বেগম (৩৫) নামের একজন বলেন, নবাবগঞ্জের চারাখালী গ্রামে তাঁদের জমিজমা ছিল। সেই জমি পদ্মায় বিলীন হয়েছে। এরপর পাঁচটি পরিবার এখানে জমি ভাড়া নিয়ে নিজেরা টিনশেড ও ছাপরাঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। প্রতিবছর জমির ভাড়া দিতে হয় সাত হাজার টাকা।
দোহার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ মিয়া বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এ ছাড়া নদীভাঙন রোধ ও বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতিমধ্যে নদীভাঙন এলাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
পাউবোর ঢাকা বিভাগ-২-এর উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, দোহারে পদ্মার ভাঙনকবলিত সাড়ে তিন কিলোমিটার তীর সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পে ১৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।