কবরে লুকিয়ে থেকেও রেহাই পাননি তিনি

সাতক্ষীরায় ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের নেতা আজহারুল ইসলাম। গতকাল রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিনিধিদল আজহারুলের বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন  ছবি: প্রথম আলো
সাতক্ষীরায় ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের নেতা আজহারুল ইসলাম। গতকাল রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিনিধিদল আজহারুলের বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছবি: প্রথম আলো

এলাকার কেউ মারা গেলে লাশ বহনের জন্য খাটিয়া কিনে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁকে বহনের জন্যই সেই খাটিয়া পাওয়া গেল না। জানাজায়ও অংশ নিয়েছে মাত্র পাঁচ-ছয়জন মানুষ। এমনই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে হত্যাকারী বলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা।
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা আজহারুল ইসলামের শোকবিহ্বল পরিবারের কাছে গতকাল শনিবার জানা গেল এ কথা।
আজহারের পরিবার জানায়, জামায়াত-শিবিরের ভয়ে আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁর জানাজায় অংশ নেওয়ার সাহস পর্যন্ত পাননি। মাত্র পাঁচ-ছয়জন মানুষ জানাজার নামাজ পড়েন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই আজহারুলের গ্রাম যুগীবাড়ী বাজারে তাণ্ডব শুরু করে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
আজহারুলের স্ত্রী মোসাম্মৎ শামসুন্নাহার বলেন, ১২ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর আজহার খবর পান বাজারে তাঁর দোকান ভাঙচুর শেষে বাড়ির দিকে আসছে হামলাকারীরা। তিনি পারিবারিক কবরস্থানের একটি পুরোনো কবরের গর্তে লুকান। সেখান থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, এখনো আতঙ্কে রয়েছেন তাঁরা। যৌথ বাহিনীর টহল দল চলে গেলেই চলে চোরাগোপ্তা হামলা।
গতকাল আজহারুলের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবেদ খান, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, সাদেকা হালিম, সন্জীদা খাতুন, জিয়াউর রহমান, কাবেরী গায়েন ও রোকেয়া প্রাচী।
যুগীবাড়ীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি ইউনিয়নের কুচপুকুরে গিয়ে একজনকেও পাওয়া গেল না। এ গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম কয়েক দফা আক্রান্ত হয়েছেন। এখন তিনি থাকেন সাতক্ষীরা সদর থানার পুলিশ ব্যারাকে। ৫ ডিসেম্বর নজরুলের বড় ভাই সিরাজুল ইসলামকে (৫৫) নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৭ জুন নজরুলের ওপর ছুড়ে মারা বোমায় গুরুতর আহত হন তাঁর বড় বোন ও ভগ্নিপতি জাহান আলী।
নজরুলের সঙ্গে আলাপ হলো সদর থানা কম্পাউন্ডে। জানালেন, তাঁর ওপর প্রথম হামলা হয় জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় হওয়ার পরের দিন। সেদিন তাঁদের বাড়ির ১০টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পরে জামায়াতের পক্ষ থেকে আবুল খায়ের ও আসগর আলী তাঁদের দলে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরপর ১৪ মে তাঁকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। নজরুল বলেন, আক্রমণকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে চিনতে পেরেছিলেন। এক মাস পরই আবার বোমা হামলা হলে গ্রাম ছাড়েন তিনি।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে নজরুল বলেন, ‘ভাই, গ্রামে পরিবার (স্ত্রী), একটা মেয়ে আর একটা ছেলে থাকে। সারাক্ষণ ওদের জন্য ভয়ের মধ্যে দিন কাটাই।’
নজরুল কয়েকটি মামলা করলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তিনি মনে করেন, আসামিদের প্রতি আশ্রয় দিতে আগ্রহী অনেক লোক থাকায় তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আজহারের ঘটনায় পুলিশবাদী মামলায় জামায়াত-শিবিরের কয়েকজন কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ দারা খান। তবে যুগীবাড়ী গ্রামের মানুষ পুলিশের ভূমিকা, বিশেষ করে ওসির ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। গতকাল তাঁরা ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’-এর প্রতিনিধিদের সরকারি কর্মকর্তা মনে করে তক্ষুনি ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
ওসি শাহ দারা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কতিপয় সুবিধাবঞ্চিত লোক’ এ কাণ্ড করেছে। তিনি যথাযথভাবেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।’