দোকান-বাড়ি-মন্দিরে হামলা

হরতাল-অবরোধ আর রাজনৈতিক সহিংসতায় চাপা আতঙ্কে আছেন সিরাজগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা বলছেন, বরাবরই যেকোনো ঘটনা ঘটলেই আওয়ামী লীগের সমর্থক—এমন অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির সময় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের ওপর হামলার অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের ওপর সর্বশেষ বড় হামলাটি হয়েছে বেলকুচি উপজেলার টেঙ্গাইসা গ্রামে। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকেরা উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য তপন চন্দ্র সরকারের তিনটি বাড়ি ও তাঁত কারখানা এবং তাঁর ভাই গোপাল চন্দ্র সরকারের তাঁত কারখানা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। একই দিন মাধবপুরে বাজারে হিন্দুদের চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। গত বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে তপনের পোড়া ঘর ও তাঁতের কারখানার ভস্মীভূত অবশেষ দেখেছেন এই প্রতিবেদক।
কথা বলতে চাইলে তপন চন্দ্র সরকার আহাজারি করে বলেন, ‘আমার প্রায় ৫০ লাখ টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়েছে। কী হবে এসব বলে! বাড়ির একটা হাঁড়ি-পাতিলও অবশিষ্ট নেই যে ছেলেমেয়েদের রান্না করে খাওয়াব।’
তপনের গ্রামে হামলার দুদিন পর ১৪ ডিসেম্বর শনিবার রাতে সদর উপজেলার সয়দাবাদ এলাকার শত বছরের পুরোনো খিদির বটতলা গ্রামের কালীমন্দির ভাঙচুর করা হয়।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর সদর উপজেলায় শিয়ালকোল মহাশ্মশান কালীমন্দিরের তিনটি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, সেদিন বিকেলে হরতালের সর্মথনে বের হওয়া ১৮ দলের মিছিল থেকে মন্দিরে হামলা চালানো হয়।
অবরোধ চলার সময় শাহজাদপুর উপজেলার পোরজনা ইউনিয়নের জামিরতা উত্তর পাড়ার কালী ও হরি মন্দিরের ১১টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।
মন্দির কমিটির সদস্য ও জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য স্বপন সান্যাল জানান, ২৭ নভেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে দুর্বৃত্তরা জামিরতা কালী মন্দিরের কয়েকটি এবং পাশের হরি মন্দিরের রাধাকৃষ্ণসহ ১১টি প্রতিমা ভাঙচুর করে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশের রাধাগোবিন্দ মন্দিরটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বারান্দার গ্রিল ও দরজা ভেঙে দুর্বৃত্তরা মন্দিরে প্রবেশ করে। এ সময় তারা মন্দিরে থাকা সব মূর্তি ভেঙে ফেলে এবং আটটি কষ্টিপাথরের শিলা, বিগ্রহের হাতের রুপার বাঁশি ও গায়ের স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় থানায় একটি মামলা হলেও আসামিরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
তাড়াশ উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা সনাতন সংস্থার সভাপতি তপন গোস্বামী বলেন, ‘রাধাগোবিন্দ মন্দিরে হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা আমরা কখনো ভাবিনি। আমরা এখন সব সময় আতঙ্কে থাকি।’
এ ছাড়া অক্টোবর মাসে সদর, তাড়াশ ও কামারখন্দ উপজেলার আরও কয়েকটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সিরাজগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ হামলাকারীদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি।...নির্বাচনের আগে এবং পরে বলির পাঁঠা করা হয় হিন্দুদের। আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই যদি এসব ঘটে, তাহলে সামনে কী হবে, সেসব ভেবে তারা আতঙ্কিত।’
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের জয়ের পর দেশের আরও অনেক স্থানের মতো সিরাজগঞ্জেও সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের ওপর ব্যাপক অত্যাচারের ঘটনা ঘটে।
জেলা পুলিশ সুপার এস এম এমরান হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যেসব এলাকায় সংখ্যালঘু বেশি, সেসব এলাকার হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আমরা তাদের সব সময়ই আশ্বস্ত করি। আমার মনে হয়, কারও ভয় পাওয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’