পরিকল্পনা করে হত্যা আ. লীগকে, শিবির মরছে সংঘর্ষে

একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত শনিবার পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তরফের অন্তত ২৫ জন সহিংসতার বলি হয়েছেন। এ সময়ে হরতাল-অবরোধে নিহত হন জামায়াত-শিবিরের ২৫ জন এবং বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ১৭ জন।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও সাতজন করে জামায়াত ও বিএনপি নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে। সব মিলিয়ে গত ২৮ দিনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৮১ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া নিহত সাধারণ মানুষের সংখ্যা ৪৬ জন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং ঘোষিত তফসিল বাতিলের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট ২৬ নভেম্বর থেকে সারা দেশে পাঁচ দফায় অবরোধ কর্মসূচি দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা।

২৬ নভেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় সবাই মারা গেছেন হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বেশি মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে।
উভয় তরফেরই প্রায় সবাই ছিলেন জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূলের নেতা-কর্মী। ঘটনার ব্যাপ্তি ২৯ জেলায়। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সাতক্ষীরা জেলায়, তার পরই লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে।

আওয়ামী লীগ লক্ষ্যবস্তু: আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট নিহত ২৫ জনের ২৩ জনই ছিলেন পরিকল্পিত হামলার শিকার। এঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একজন সাক্ষী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জামায়াত-শিবিরের। তাঁদের মারা হয়েছে পিটিয়ে, কুপিয়ে, জবাই করে, পুড়িয়ে বা গুলি করে।

আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের প্রভাবাধীন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সাতক্ষীরা। এখানে নিহত ১৬ জনের ১০ জনই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বা সমর্থক-সমমনা, যাঁদের পরিকল্পিতভাবে মারা হয়েছে। ২৮ নভেম্বর রাতে নরসিংদীর পলাশে উপজেলা ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় হামলা চালান পৌর ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ছাত্রলীগের সদস্য আনোয়ার হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করেন। গুরুতর আহত হয়ে মারা যান আরেক সদস্য শহিদুল্লাহ মিয়া। ১৪ ডিসেম্বর নীলফামারীতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সাংসদ আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা করে। মারা যান আওয়ামী লীগ পক্ষের চারজন এবং শিবিরের একজন
সংঘর্ষে নিহত বিএনপি-জামায়াত: ১০ ডিসেম্বর রাত থেকে কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু জায়গায় পুলিশ, র‌্যাব ও যৌথ বাহিনী দমন-অভিযানে নেমেছে। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট নিহত ব্যক্তিদের ৪৬ জনই এ সময় মারা গেছেন।

২৬ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ৪০ জন নিহত হন। তাঁদের প্রায় সবাই জামায়াত-শিবির বা বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদলের নেতা-কর্মী।
১৪ ডিসেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে সাতজন জামায়াত-শিবিরের কর্মী নিহত হন। পরদিন লালমনিরহাটের পাটগ্রামে একইভাবে শিবিরের তিনজন নেতা-কর্মী এবং তার জের ধরে জামায়াত-শিবিরের হামলায় একজন আওয়ামী লীগের নেতা নিহত হন। লক্ষ্মীপুরে র‌্যাব-পুলিশের হাতে মারা যান বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের অন্তত পাঁচজন।
বিএনপি পক্ষের ছয়জন এবং আওয়ামী লীগ পক্ষের চারজন নেতা-কর্মীকে হত্যার পেছনে অন্য হিসাব-নিকাশও থাকতে পারে।

শোকাতুর পরিবারের কথা:
১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ হলে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়ায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সড়ক আটকে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষের সময় সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আনোয়ার হোসেন (১৭)। একাধিক সূত্র বলেছে, আনোয়ার শিবির করত। আনোয়ারের মা জাহানারা বলেন, ‘এটা সরকারের ব্যাপার।’ তবে দেশের ‘অসুস্থ রাজনীতি’কে দায়ী করে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগেই এ অবস্থা—সামনে না জানি কী আসছে!

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। গত মার্চ থেকে জামায়াত-শিবির তিনবার তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপর হামলা করেছে। দেড় মাস ধরে নজরুল বাড়িছাড়া। এরই মধ্যে চিহ্নিত জামায়াত-শিবির কর্মীরা ৫ ডিসেম্বর বাড়িতে তাঁর বড় ভাই সিরাজুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করেছেন। নজরুল বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’ তবে এলাকার জামায়াতের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি আপনার দল করেন, আমি আমার দল করি। কিন্তু আমরা এক মসজিদে, একই ঈদগায় নামাজ পড়ি। আমরা কেন একজন আরেকজনকে খুন করব?’
[প্রতিবেদনে সাহায্য করেছেন রাজীব নূর, ঢাকা ও মুজিবুর রহমান, লাকসাম]