আ.লীগের মাঠপর্যায়ে আবার হানাহানি

>

সংঘাতের অন্যতম কারণ জলমহাল, বালুমহাল, ঠিকাদারি ও মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার

দিরাইয়ে গত মঙ্গলবার সংঘর্ষে নিহত একজনের স্বজনের আহাজারি
দিরাইয়ে গত মঙ্গলবার সংঘর্ষে নিহত একজনের স্বজনের আহাজারি

মাস তিনেক বিরতি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আবারও সংঘাত-হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ এলাকায় প্রভাব বিস্তার এবং জলমহাল, বালুমহাল, ঠিকাদারি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহালের দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৩ জন। আহত হয়েছেন আরও ২২ জন। আগের দিন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাইউম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। কাইউম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান।
গত বছরের জুলাইয়ে খুলনায় ও কুমিল্লায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পৃথক তিনটি ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মী খুন হন। এরপর সাড়ে তিন মাস তেমন হানাহানি ছিল না। গত নভেম্বরের শেষ দিকে আবার অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হতে থাকে ক্ষমতাসীন দলটি। ১৯ নভেম্বর স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ।
পরদিন নিজ বাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর স্বজনদের অভিযোগ, হত্যার পর তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই ঘটনার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখছেন নিহতের পরিবার ও আওয়ামী লীগের নেতারা।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

নতুন বছরের শুরুতেই সংবাদ শিরোনাম হয় খুলনায় আওয়ামী লীগ। আগের দিন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে গুলি করে তাঁর প্রতিপক্ষরা। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিহত হন এক পথচারী নারী। জেড এ মাহমুদ অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে ৩১ জুলাই খুলনায় পলাশ-রোহান গ্রুপের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও ছাত্রলীগের নেতা সৈকত রোহানকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় করা মামলায় জেড এ মাহমুদ আসামি। এর আগে ১৭ জুলাই একই গ্রুপের সদস্য আল আমিন ওরফে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় পুলিশ বলছে, এই পলাশ-রোহান গ্রুপ শহরের একটা অংশে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত।

অভ্যন্তরীণ এসব সংঘাতের বিষয়ে গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের মত হচ্ছে, এসব সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কারণ খুবই কম। ঠিকাদারি ও মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কিংবা জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দখল প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের নেতাদের মধ্যে এখন অনেক স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব নেতা আরও বলেন, বিরোধীরা মাঠে না থাকার কারণে এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ নিজেই। ক্ষমতাসীন বলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ভয় পায় না। এ জন্যই সংঘাত ও সহিংসতা বেড়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী বছরটা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বেশ ভ্রাতৃঘাতী। এর মধ্যে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে বেশ কয়টি সংঘাত হয়। জুনে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সারা দেশে সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ৭১ জন, যাঁরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারান।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। আর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হন ১৫৩ জন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দল-উপদলের মারামারিতে মারা যান ৩৩ জন। এর আগের বছর নিহতের সংখ্যা ১৪৭। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এই হিসাব তৈরি করে আসক।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত দলের বিভিন্ন ইউনিটের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কিছু সংঘাত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগে এমন ঘটনা নেই। আসলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বেশি হওয়ার কারণে সংঘাত-প্রাণহানি বেশি। আর দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে স্বার্থের সংঘাতও আছে। বাংলাদেশে এটা নতুন নয়। তিনি বলেন, এরপরও সরকার অপরাধে কোনো ছাড় দিচ্ছে না, ভবিষ্যতেও দেবে না। সামনে চ্যালেঞ্জিং জাতীয় নির্বাচন আসছে। তাই অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য দল খুবই তৎপর।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পেছনেও অবৈধ অর্থ উপার্জন ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এর জন্য আওয়ামী লীগ দুর্নামের শিকার হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এমনকি সর্বশেষ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযোগ রয়েছে।

ওই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের সরকার আট বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে—এটা তাঁরা যেমন গর্বের সঙ্গে বলে থাকেন, আবার এটাও স্বীকার করতে হবে যে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটা অংশের নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বত্র কামড়াকামড়ি চলছে।

আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে রাজনীতিতে ভালো মানুষের কদর আছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। আগামী নির্বাচনের আগে দল অভ্যন্তরীণ সংঘাত না মেটাতে পারলে এর মূল্য দিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফায়দা দেওয়া ও নেওয়া। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে নতুন নতুন ফায়দা নেওয়ার লোক তাদের দিকে ঝুঁকছে। ফলে প্রতিযোগিতাটা বেড়ে গেছে। যার ফলাফল হচ্ছে নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও প্রাণহানি। তিনি বলেন, ফায়দা নেওয়া রাজনীতিকদের কেউ কেউ এখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এসেছেন। আর এখন যাঁরা ফায়দা নিচ্ছেন, তাঁরাও হয়তো একদিন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাবেন। তখন পরিস্থিতি কী হবে, ভাবতে গেলেও ভয় লাগে।