উপার্জনক্ষম স্বজন হারিয়ে বিপাকে পরিবারগুলো

সকালে আলু সিদ্ধ দিয়ে দুমুঠো ভাত খেয়েছিলেন সুরেছা বেগম (২০)। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। ঘরে চাল-পাত নেই, তাই চুলো জ্বলেনি। স্বামী মারা যাওয়ার দিন থেকে বিছানায় পড়ে আছেন তিনি। উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই।

সুরেছা গত মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জারলিয়া জলমহালের দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাহারুল ইসলামের (২৮) স্ত্রী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সাহারুলকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখন দিশেহারা। শুধু সাহারুল নন, ওই সংঘর্ষে নিহত আকিলনগর গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া (৩০) ও হাতিয়া গ্রামের তাজুল ইসলামের (৩৩) পরিবারেরও একই অবস্থা।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে কুলঞ্জ ইউনিয়নের আকিলনগর গ্রামের পাশে জারলিয়া জলমহালের অবস্থান। এই জলমহালের দখল নিয়ে দিরাই পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশারফ মিয়া এবং স্থানীয় হাতিয়া গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য একরার হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়।

গতকাল রোববার দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যে জলমহালটির দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে সেটি আসলে মরা নদী। স্থানীয়ভাবে এটি জালিয়া নদী হিসেবে পরিচিত। জলমহালের পাড়ে আকিলনগর গ্রাম। গ্রামের সবাই হতদরিদ্র, অন্যের জমি বর্গাচাষ করে জীবন চলে তাদের।

ঘর থেকে বের হয়েই সাহারুল ইসলামের মা সেলিনা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। বলেন, ‘ঘরের খাওন নাই, ছোট একটা বাইচ্চা (হানিফা) রাইখা গেছে। হেই তো (সাহারুল) একলা কাম-কাজ কইরা আমরারে খাওয়াইত। এখন আমরা বাঁচতাম কিলা, খাইতাম কিলা। আমরার সব শেষ অইগিছে।’

গ্রামে সাহারুলদের মাটি ও খড়কুটার ভাঙাচোরা একটি ঘর। বাবা ইছাক মিয়া হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। কোনো কাজ করতে পারেন না। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সাহারুল সবার বড় ছিলেন। তিনি কখনো কৃষিকাজ, আবার কখনো শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। বাবা ইছাক মিয়া বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। আমার পুয়ারে (ছেলে) তারা মারল কেনে। হে তো কোনো দিন বিলে যায় নাই। আমি সবার বিচার চাই।’

উজ্জ্বল মিয়ার খুপরিঘরে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। উজ্জ্বল মারা যাওয়ার আগে স্ত্রী সাহানা বেগম (২২), এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখানে থাকতেন। তাঁর শ্বশুরবাড়িও একই গ্রামে। উজ্জ্বলের লাশ দাফনের পর মেয়ে ও নাতি-নাতনিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছেন মিমরাজ বিবি (৫০)। সাহানা বেগমকে সেখানে গিয়ে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমার তো আর যাইবার জাগা নাই। আমি কই যাইমু। কে আমারে দেখব। আমার দুইটা বাইচ্চার কিতা অইব।’ মিমরাজ বিবি জানান, উজ্জ্বল ঘটনার সময় পাশের খেতে কাজে ছিলেন। জলমহালের কোনো ঝামেলায় ছিলেন না। সাহারুল তাঁর ভাগনে হয়। সাহারুলকে গুলি করার পর উজ্জ্বল তাঁকে আনতে গিয়েছিলেন। পরে তাঁকেও গুলি করা হয়। তিনি আরও বলেন, উজ্জ্বল হাতিয়া গ্রামের দবির মিয়ার বাড়িতে ছয় মাসের চুক্তিতে কাজে ছিলেন। যারা মারামারি করেছে তাদের কারও পক্ষেই তিনি ছিলেন না।

তাজুল ইসলামের বাড়ির উঠানে দাঁড়াতেই ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। জানা গেল, তাঁর বৃদ্ধ মা জয়তন বিবি (৫৫) ছেলের জন্য কাঁদছেন। তাঁর কান্না যেন থামছে না। তাজুলের ছোট ভাই আজহারুল ইসলাম বলেন, তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তাজুল ছিলেন সবার বড়। তিনিই সংসার চালাতেন। তাজুল ইসলাম একরার হোসেনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ কারণেই তাঁকে মারা হয়েছে। আজহার আরও জানান, তাজুল ইসলামের ছোট ছোট চার মেয়ে ও এক ছেলে আছে। তাঁকে হারিয়ে এখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

গ্রামের বাসিন্দা আফছার মিয়া (৬২) বলেন, ‘স্বার্থ নিয়া বড়লোকেরা মারামারি করছে, আর মরছে তিনটা গরিব মানুষ। যারা এসবের সাতেপাছে আছিল না। এখন তো তিনটা পরিবার পথও নামতে অইব।’

জলমহালে পুলিশ ক্যাম্প: জারলিয়া জলমহালের মাছ ধরার খলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লাল পাতাকা টানানো। ভেতরে পুলিশ অবস্থান করছে। দিরাই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসমাইল আলী বলেন,‌ ‘ঘটনার পর থেকেই এখানে আমরা ২৫ জন আছি। পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ নেই। সব আমাদের হেফাজতে আছে।’

ছয় দিনেও কোনো গ্রেপ্তার নেই: জলমহালে সংঘর্ষ ও তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার দিরাই থানায় পাল্টাপাল্টি দুটি মামলা হয়। একরার হোসেন বাদী হয়ে দিরাই পৌরসভার মেয়র মোশারফ মিয়া, দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ও দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়সহ ৩৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। জলমহাল লুটপাটের অভিযোগে একরার হোসেনসহ ২৯ জনকে আসামি করে অপর মামলাটি দায়ের করেন স্থানীয় নাগেরগাঁও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধনঞ্জয় দাশ। কিন্তু ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এই দুই মামলার কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জলিল গতকাল রোববার সন্ধ্যা ছয়টায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।’