এটা কি কোনো মানুষের কাজ?

বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধ রাবেয়া। পাশে অসহায় মেয়ে। ছবি: সোয়েল রানা
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধ রাবেয়া। পাশে অসহায় মেয়ে। ছবি: সোয়েল রানা

প্রায় ৩০ বছর আগে জীবিকার খোঁজে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বেলঘড়িয়া গ্রাম ছেড়ে রিকশাচালক স্বামীর সঙ্গে বগুড়া শহরে এসেছিলেন রাবেয়া বেগম (৫০)। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন শহরের মালগ্রামে। স্বামী কাশেম প্রামাণিক (৬০) এখনো শহরে রিকশা চালান। কিন্তু রিকশা চালানোর উপার্জন দিয়ে তাদের দুজনের সংসার চলে না। তাই স্বামীর ভার কমাতে রাবেয়া মহল্লার গলির মোড়ে ফুটপাতে ভাজা পাঁপড় আর পিঁয়াজি বিক্রি শুরু করেন।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ফুটপাতে বসে গরম তেলে পিঁয়াজি-পাঁপড় ভাজছিলেন রাবেয়া। এ সময় মহল্লার এক শিশু পাঁপড় কিনতে আসে। কিন্তু দিতে দেরি হওয়ায় ওই শিশুর বাবা ও দুই খালা এসে রাবেয়া বেগমের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে শিশুটির বাবা মহল্লার মুদিদোকানি শরিফ উদ্দিন খেপে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে লাথি মারেন। ফুটন্ত তেল ছিটকে পড়ে রাবেয়া বেগমের শরীরে। এতে পুড়ে যায় রাবেয়ার মুখমণ্ডল ও গলা।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে শহরের মালগ্রাম মহল্লার কলেজপাড়া মোড়ে এই নির্মম ও অমানবিক ঘটনা ঘটে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাবেয়াকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান মো. আবদুল মোত্তালেব হোসেন আজ শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ফুটন্ত তেলে রাবেয়া খাতুনের মুখমণ্ডল, গলাসহ শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশ ঝলসে গেছে। তাঁর অবস্থা সংকটপূর্ণ। আজ শনিবার দুপুরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে।

ঢাকায় পাঠানোর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রাবেয়া বেগমকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা যায়। ফুটন্ত গরম তেলে গোটা মুখমণ্ডলই ঝলসে গেছে। দগ্ধ হয়েছে গলার সামনের অংশও।

ফুটন্ত তেলে মায়ের দগ্ধমুখ দেখে বাক্‌রুদ্ধ মেয়ে কল্পনা আকতার। হাসপাতালের শয্যাপাশে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন কল্পনা।
কীভাবে এ ঘটনা ঘটল, জিজ্ঞাসা করতেই অঝোরে কেঁদে ফেলেন কল্পনা। বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে বাবা ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারেন না। মা নারী হয়েও কষ্ট করে ফুটপাতে বসে পাঁপড় ভাজা বিক্রি করে ভাত জোগাচ্ছিলেন। সেটাই কাল হলো। বিনা দোষে গরম কড়াইয়ে লাথি মেরে ফুটন্ত তেল শরীরে ঢেলে দেওয়া হলো। এটা কি কোনো মানুষের কাজ? মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বৃদ্ধ বয়সে এই শাস্তি যারা দিল, তাদেরও কঠিন শাস্তি চাই।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাবেয়া বেগমের নাতি ও মালগ্রাম কলেজপাড়ার সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে কলেজপাড়ার মুদিদোকানি শরিফ উদ্দিনের ১৪ বছরের মেয়ে নানির দোকানে পাঁপড় কিনতে আসে। কিন্তু ওই সময় নানি গরম তেলে পাঁপড় ভাজায় ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি পাঁপড় নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর শরিফ উদ্দিন এবং তাঁর দুই শ্যালিকা ছবি ও মিলি এসে দোকানে পাঁপড় ফেরত দিয়ে নানির কাছে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চান। নানি তাঁদের জানান, ভাজতে দেরি হওয়ায় দিতে একটু দেরি হয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনজন মিলে নানিকে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে শরিফ উদ্দিন চুলার ওপরে থাকা ফুটন্ত তেলভর্তি গরম কড়াইয়ে লাথি মারেন। এতে ফুটন্ত তেল ছিটকে গিয়ে নানির মুখ ও গলায় পড়ে।

বগুড়া শহরের স্টেডিয়াম ফাঁড়ির দায়িত্বরত শহর উপপরিদর্শক (টিএসআই) আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারটি এতটা অসহায় যে রিকশাচালক স্বামীর পক্ষে চিকিৎসা খরচ চালানোর সামর্থ্যও নেই। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা না থাকায় পরিবারের লোকজন তাঁকে ঢাকায় নিতে পারছিলেন না। তাই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার জন্য তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়েছি। এ ঘটনায় রাবেয়া বেগমের মেয়ে কল্পনা আকতার বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় শরিফুল ইসলাম, তাঁর দুই শ্যালিকা ছবি আকতার ও মিলি আকতারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকেই আসামিরা গা ঢাকা দিয়েছেন।