উৎসাহ নেই বড়দিনের উৎসবে

বুকে বিঁধে আছে ভয়ের কাঁটা। তার ওপরে দাদনের টাকা ফেরত দেওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফসল বিক্রি হচ্ছে না। মাঠের কাজ বন্ধ। অভব-অনটন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অনেকেরই দিন যাচ্ছে একবেলা নুন দেওয়া লাল চা আর ভুজা (চাল ভাজা) আর একবেলা ভাত খেয়ে। এরই মধ্যে এসেছে উৎসব। দিন পেরোলেই বড়দিন। কিন্তু এবার কোনো উৎসবের রেশই দেখা গেল না বরেন্দ্র এলাকার খ্রিষ্টানপ্রধান আদিবাসী গ্রামগুলোতে। এমনকি বড়দিনের ভোজটি পর্যন্ত হচ্ছে না বেশির ভাগ গির্জায়।
বৃহত্তর রাজশাহী জেলাগুলোর আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও—এরাই সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া আছে কোল, মুন্ডা, মাহালে, তুরি, মালপাহাড়িয়া। এদের মধ্যে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। গতকাল সোমবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গোদাগাড়ীর কয়েকটি আদিবাসী গ্রামে ঘুরে দেখা গেল, ভয়ে আর অভাবে কুঁকড়ে আছেন দুর্গম বরেন্দ্র এলাকার মাটিঘেঁষা এসব মানুষ। । যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির পর তাদের জেলার বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী ঘটনা আতঙ্কিত করে রেখেছে তাদের। যদিও সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদিবাসী এলাকায় বড় কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। তবে ঘটনা যে ঘটবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তাঁরা। উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি নাচোলের মহানইল গ্রামের হিংগু মুরমু বলছিলেন, ‘আমরা কি দেশে থাকতে পারব? কাদের মোল্লার ফাঁসির পর আদিবাসীরা খুব ভয়ে ভয়ে আছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে টেলিফোন করে আমার কাছে তারা জানতে চাচ্ছে, জানপ্রাণ বাঁচবে তো।’ তিনি আমাদের বলছিলেন, আদিবাসী গ্রামগুলোতে হামলা হলে কোনো রক্ষা নেই। উঁচুনিচু টিলার মতোন বরেন্দ্র এলাকায় ভেতর দিকে কোনো পাকা রাস্তা নেই। এবড়োখেবড়ো মেঠো পথ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা সেখানে যাবেই না। আদিবাসীদের ভয়টি এখানেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ঝিলিম ইউনিয়নের দক্ষিণ শহর গ্রামের শুকুরমণি হাসদা ও ছেলের বউ নীলিমা মুরমু ঘরের দেয়ালে নতুন মাটির গোলার প্রলেপ দিচ্ছিলেন। বড়দিনের প্রস্তুতি বলতে এটুকুই। কেনাকাটা করা হয়নি কিছুই। শুকরমণি জানালেন, তাঁরা পাঁচ বিঘা বর্গা জমিতে আমন চাষ করেছিলেন। ফলন হয়েছে বিঘায় ১২ মণ করে। তাঁরা পেয়েছেন মোট ৩০ মণ। চাষ করতে চাঁপাইয়ের মহাজনের কাছে থেকে দাদন নিয়েছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। তাঁকেই দিতে হবে ১০ মণ ধানের দাম। এই এলাকায় আমনের মণ এখন চলছে সাত শ টাকা। অবরোধের কারণে ধান এবং যাঁরা টমেটো, মরিচ, বেগুন চাষ করেছিলেন, তাঁরা সেগুলো বিক্রি করতে পারছেন না। এই গ্রামের ববিতা হাসদা জানালেন, বড়দিনের কোনো কেনাকাটা করা হয়নি।
বরেন্দ্র এলাকার এসব জমিতে সেচের প্রধান উৎস বরেন্দ্র প্রকল্পের গভীর নলকূপের পানি। প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত না হলে এই সুবিধা পাওয়া যায় না। ধান চাষের জন্যই প্রধানত সেচ-সুবিধা দেওয়া হয়। এ কারণে আদিবাসীরা মূলত ধানের ওপরেই নির্ভরশীল। সেই ধানের দর পড়ে যাচ্ছে। ঝিলিমের দক্ষিণ গ্রামের গির্জায় এবার বড়দিনের ভোজটিই হচ্ছে না। গির্জার পাস্টার স্যামুয়েল হেমব্রমের স্ত্রী শীলা মরমু জানালেন, ২৪ ডিসেম্বর দিন বিকেলে শিশুদের নিয়ে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন তারা গির্জার প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যায় প্রার্থনা হবে। আর বড়দিনের প্রার্থনা হবে বুধবার সকালে। সকলে মিলে চাঁদা দিয়ে বড়দিনের দুপুরে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়। লোকজনের হাতে টাকা নেই, উৎসাহও নেই বলে এবার তা হচ্ছে না। পাশের গ্রাম যুগিডাং। সেখানেও একই অবস্থা।
গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং গ্রামের গির্জার পাস্টার রাজেন সরেন জানালেন, তাঁদের গির্জায় বড়দিনের ভোজের আয়োজনের উদ্যোগ এখনো আছে। চাঁদা ধরা হয়েছে জনপ্রতি ৫৫ টাকা। অর্ধেকের বেশি লোকই দিতে পারবে না জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভোজ যদি হয়ও, তবে সবাই এবার অংশ নিতে পারবেন না। উৎসবের দিনে এ ঘটনা হবে খুবই দুঃখজনক। কিন্তু উপায় কী ? গির্জার পাশেই ফুলমণি মুরমুর বাড়ি। স্বামী নেই। দুই ছেলেমেয়ে। জমি নেই, কাজ নেই। হাতে টাকাও নেই। বড়দিনের ভোজে অংশ নিতে পারবেন না। বলছিলেন ‘আমাদের সবদিকে দুঃখ। আপনি কয়টার কথা লিখবেন।’ সত্যি তো, আনন্দ-উৎসবের দিনটিতেও যাদের ভয় আর দুঃখ-কষ্ট ঘিরে থাকে, তাদের সব কথা কি আর লেখা যায়!