বাবার কাঁধে ছেলের লাশ!

নিহত মেহেদী হাসানের স্ত্রী রীতা বেগম
নিহত মেহেদী হাসানের স্ত্রী রীতা বেগম

সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন জয়নগর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ওরফে জজ মিয়ার স্ত্রী রীতা বেগম। ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের খবর প্রচারের পর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের সরসকাঠি গ্রামের মেহেদী হাসানকে।
রীতা বারবার বলছিলেন, ‘তখনো কেউ পাশে ছিল না। এখনো নাই।’ বুকফাটা কান্না সামলে তিনি বলেন, ‘লোকটা খুন হইল এত দিন হইয়ে গেল, একবারও কেউ আসে নাই। ইলেকশনের সময় যে ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের জন্য গেলবার জানপ্রাণ দিইয়ে ভোট করিলেন, তাইনেও একটিবার ফোন কইরে খবর নিলেন না।’
দোতলা বাড়ির সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন রীতা। একটুখানি দূরে ছোট বোন ইভাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল মেহেদীর বড় ছেলে আবুল কালাম ওরফে শুভ। কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মেহেদীর বাবা সত্তরোর্ধ্ব নিজামউদ্দিন মোড়ল।
নিজামউদ্দিনের আক্ষেপ, ‘ঘরবাড়ি চইলে গেলে ঘরবাড়ি হয়। মানুষ গেলে কি আর ফিরে আসে? পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের ওজন কতখানি হয়, তা কি আপনারা বুঝেন?’
রীতা প্রশ্ন করেন, তাঁর সন্তান দুটির কী হবে? বড় হয়ে মাত্র এক বছর দুই মাসের ইভা কি মনে করতে পারবে, বাবা তাকে কত ভালোবাসতেন?
মেহেদীর বড় ভাই জয়নগর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান মোড়ল বলেন, ‘ভাই খুন হওয়ার রাত্রিরে মাত্র ২০০ গজ দূরের পুলিশ ফাঁড়িতে বারবার ফোন দিয়েছি। কলারোয়া থানার ওসিকে অনুরোধ করেছি, পুলিশকে বলেন, এসে দুইটা ফাঁকা গুলি ছুড়ে দিয়ে যাক। কেউ শুনে নাই। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নাম্বারে রিং দিয়েছি, তাঁর মোবাইল বাজে নাই। ওরা আমার ভাইকে বাড়ি থেকে ১০০ গজ দূরে নিয়ে গলা কেটে ফেলে রেখে গেল।’
ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর হলেন সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সাংসদ শেখ মুজিবুর রহমান। এই আসনে তিনি এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, কিন্তু মনোনয়ন পাননি। মুজিবর সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। থাকেন ঢাকায়। জেলাজুড়ে সহিংসতা শুরুর ৩৩ দিন পর গতকাল সোমবার পর্যন্ত এলাকায় আসেননি তিনি। কলারোয়া উপজেলার ওই গ্রাম-জনপদে এখনো আতঙ্ক রয়েছে। ঘটনার আট দিন পর গত শুক্রবার আমরাই প্রথম সাংবাদিকদের একটি দল ওই গ্রামে যাই। তবে এ জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল দলের সহযোগিতা নিতে হয়েছে। পরের দিন শনিবার ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ নামের একটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যাই যুগীবাড়ীতে আওয়ামী লীগের নিহত নেতা আজহারুল ইসলামের বাড়িতে। এদিনও ওই এলাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে যৌথ বাহিনী সহযোগিতা দেয়। এ ছাড়া কলারোয়ায় ২৭ নভেম্বর একই দিনে দেয়াড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান খুন হয়েছেন। এখনো তাঁদের বাড়িতে যেতে পারিনি আমরা। আতঙ্কিত এই জনপদে জামায়াত-শিবির যাঁদের প্রতিপক্ষ বলে ধরে নেয়, তাঁদের চলাচল করা এখনো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
আওয়ামী লীগের নেতা ও হিন্দুদের অনেকেই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানালেন জেলার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিশ্বজিৎ সাধু। তিনি বলেন, ‘কেউ বৈধ, কেউ আবার অবৈধ পথেও গেছেন বলে শুনেছি। তবে দল বেঁধে নয়, এবার মানুষ চুপিসারে এলাকা ছাড়ছেন। সাতক্ষীরা শহরেও আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই।’
শহরে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর আহমদ বলেন, ‘দল করে ঘরবাড়ি সব হারালাম। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন পথে পথে ঘুরছি। অথচ দলের কোনো নেতা খোঁজও নেয়নি। জামায়াত-শিবির ১৩ ডিসেম্বর তাঁর নিজের ও ভাইয়ের বসতবাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ধ্বংস করেছে। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম শওকাত হোসেন অকপটেই বলেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কারও বাড়িতে যেতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সাতক্ষীরা শহর ও শহরতলির চারটি ইউনিয়নে থাকতে পারলেও শহরের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ১০টি ইউনিয়নে এখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। তাই আওয়ামী লীগের ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না।