শিক্ষার্থীর অস্ত্রোপচারের জায়গায় ছাত্রলীগ নেতার লাথি!

নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম উদদীন হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে ছাত্রলীগ। তাঁরা ওই শিক্ষার্থীর পেটে লাথি মারে, যেখানে সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতাকে এবং জগন্নাথ হলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীকেও মারধর করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার এসব ঘটনা ঘটে। এর আগে বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দীর্ঘদিন মোটামুটি শান্ত থাকার পর হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ।

আজ বৃহস্পতিবার চারুকলায় ক্যানটিনের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতাকে মারধর করেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। আহত রাজীব কুমার দাশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমাজকল্যাণ সম্পাদক।
ছাত্র ইউনিয়নের অভিযোগ, গত ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবনের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে জাতীয় কমিটির হরতালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে রাজীব চারুকলা অনুষদের ভেতরে আশ্রয় নিতে চান। ওই সময় তাঁকে চারুকলায় ঢুকতে বাধা দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে রাজীব ও কয়েকজন বিক্ষোভকারীর বাকবিতণ্ডা হয়। এর জের ধরে আজকের মারধরের ঘটনা।

হামলার শিকার রাজীব সাংবাদিকদের বলেন, ‘চারুকলা অনুষদের ক্যানটিনে চা খেতে গেলে চারুকলা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক রাইসুল ইসলাম আমাকে বের হয়ে যেতে বলে। কারণ জানতে চাইলে ছাত্রলীগের আফি আজাদের নেতৃত্বে নাজমুল, সুজন, রাইসুলসহ ৮-১০ জন নেতা-কর্মী আমার ওপর হামলা করে। চারুকলার গেটের সামনে তাঁরা সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনে আমার জড়িত থাকার কথা বলে মারধর করেন।’

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস অভিযোগ করেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই ছাত্রলীগ আগের চেয়ে বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। ধর্মঘট পালনের দিনও তারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত দখলদারিত্বের চেষ্টা করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ।’

কবি জসীম উদ্দীন হলে মারধরের শিকার শিক্ষার্থীর নাম মো. রিফাত ইসলাম। তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষে পড়া ওইা শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, রাত নয়টার দিকে তাঁকে ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইয়েরা’ ভর্তির পে-ইন-স্লিপ নিয়ে হলের ২১৫ নম্বর কক্ষে যেতে বলেন। পে-ইন-স্লিপ নিতে নিজের কক্ষে এলে তাঁর একাধিক সহপাঠী তাঁকে কর্মসূচিতে অনিয়মিত বলে গালিগালাজ করে। এমন চলতে থাকলে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মুখে ঘুষি মারে।

ভয় পেয়ে রিফাত ইসলাম হল থেকে বেড়িয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হলে ফিরলে তাঁকে আবার ২১৫ নম্বর কক্ষে ‘গেস্টরুম’ করতে ডেকে নেওয়া হয়। ‘গেস্টরুম’ ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচি যেখানে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন নিয়মকানুন শেখানো হয়। রিফাত অভিযোগ করেন, ‘গেস্টরুমে গিয়ে দেখি কয়েকজন আমার নামে বড় ভাইদের কাছে বিচার দিয়েছেন। আমি বলি, আমার পেটে কয়েক দিন আগে অস্ত্রোপচার হয়েছে। কর্মসূচিতে গেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। তখন বড় ভাইদের নির্দেশে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রেজাউল করিম, বাংলা বিভাগের শাকিল আহম্মেদসহ কয়েকজন মিলে আমাকে মারধর করেন। একজন আমার পেটের ক্ষত স্থানের সেলাইয়ে লাথি দেয়। ঘুষি দিয়ে দাঁত ও মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ফেলে।’

গেস্টরুমে ওই সময় সমাজকল্যাণ বিভাগের আবুল হোসেন, ভাষাবিজ্ঞানের শাওন আহমেদ, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সোহাগ আহমেদ, দর্শন বিভাগের তুহিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। এঁরা সবাই হলের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খানের অনুসারী বলে জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে শাহেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি হলে ছিলাম না। ঘটনা শোনার পর আমি রিফাতকে ডেকে বিষয়টির মীমাংসা করে দিয়েছি। এটা ওদের নিজেদের মধ্যে ঘটনা। রিফাতকে অন্য কক্ষে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর যারা এমনটা ঘটিয়েছে, তাদের ডেকে সাবধান করে দিয়েছি যেন ভবিষ্যতে আর এমনটা না হয়।’

একই সময়ে জগন্নাথ হলে পূজা উদযাপন করতে গিয়ে আহত হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থী। আহতদের দাবি, তাঁরা লাইন ধরে ঘুরছিলেন আর নাচানাচি করছিলেন। একপর্যায়ে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক উৎপল বিশ্বাসের অনুসারীরা তাঁদের বাধা দেন ও উল্টো দিকে ফিরে যেতে বলেন। ছাত্রলীগকর্মীদের কথা না শুনে তাঁরা পাশ দিয়ে যেতে চাইলে তাঁদের মারধর করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, ‘সবগুলো ঘটনাই আমি শুনেছি। জসীম উদ্দীন হলের ছেলেটার ব্যাপারে কী করা যায়, সেটা নিয়ে সবাইকে নিয়ে রাতে বসব। ঘটনা বিস্তারিত জেনে জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর জগন্নাথ হলের ঘটনার বিষয়ে হলের সাধারণ সম্পাদক উৎপল বিশ্বাসসহ সাতজনকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন। আর আজ রাতের মধ্যে চারুকলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’

এদিকে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে স্ট্যাম্প দিয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার সকালে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে এক পক্ষের কর্মীদের মারধর করেন। এতে প্রথম বর্ষের অন্তত চারজন আহত হন।

জিয়া হল ছাত্রলীগের একটি পক্ষের অভিযোগ, গভীর রাতে হলে গান শোনা নিয়ে পাশাপাশি দুটি গণ রুমের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় মোতাহার হোসেন তাঁর বিরোধী পক্ষের গণ রুমে ঢুকে এলোপাতাড়ি শিক্ষার্থীদের পেটান।

জানতে চাইলে মোতাহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমিতে আসবেন। এর আগেই সকালে জিয়া হলের গণ রুমে দুই পক্ষ নিজেরা ঝামেলা করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি রড দিয়ে ধাওয়া দিয়েছি। সবাইকে নিজের কক্ষে ফিরে যেতে বাধ্য করেছি। কিন্তু কাউকে মারধর করিনি।’