দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় হঠাৎ ছুরি নিয়ে হামলা

ইয়াছিন আরাফাত
ইয়াছিন আরাফাত

হোটেলে দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় ছুরি নিয়ে ছাত্রলীগের এক পক্ষ অতর্কিত হামলা চালায় প্রতিপক্ষের ওপর। এতে প্রাণ হারান ছাত্রলীগের এক কর্মী। ছুরিকাঘাতে আহত হন আরও দুজন। গতকাল শনিবার বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারের ‘আল মদিনা ভাত ঘর’ হোটেলে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ইয়াছিন আরাফাত চট্টগ্রাম নগরের সরকারি সিটি কলেজে পড়তেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নে। একই ঘটনায় আহত হারুনুর রশিদও সিটি কলেজ থেকে স্নাতক (পাস কোর্স) করছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় তাঁর চিকিৎসা চলছে। আহত আরেক যুবক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলেও পরে ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে যান। নিবন্ধন খাতায় তাঁর নাম ফাহিম লেখা ছিল।
গত ২৬ মাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে প্রাণ হারান ৭ জন। ২০১৬ সালে ৮ জন। সর্বশেষ গতকাল মারা গেলেন এক কর্মী। এর বাইরে গত বছরের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট এলাকার নিজ বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা বলছেন, দিয়াজকে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচার করার জন্য লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
সিটি কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী বলেন, হামলার শিকার ও হামলায় অংশ নেওয়া যুবকেরা চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের উপসম্পাদক আবদুল আহাদের অনুসারী। ইয়াছিনের সঙ্গে হারুনের বিরোধ ছিল। হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলেজে আধিপত্য বিস্তার নাকি অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। মাদক ব্যবসাসংক্রান্ত বিরোধও এর পেছনে থাকতে পারে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
ঘটনা সম্পর্কে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূর মোহাম্মদ বলেন, ভাত ঘরে ইয়াছিন আরাফাতসহ আরও এক-দুজন ভাত খাচ্ছিলেন। এ সময় অপর একটি পক্ষ সেখানে ইয়াছিনের ওপর হামলা করে। ইয়াছিনরা হামলা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ইয়াছিনকে মৃত ঘোষণা করেন। ইয়াছিনের বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হারুনের গলা ও দুই হাতে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আহত ফাহিমের পিঠে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি কিছুক্ষণ পর পালিয়ে যান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে সিটি কলেজে ইয়াছিনের ছোট ভাইদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া হয়। সেটা বড় ভাইয়েরা সেখানেই মিটিয়ে দেন। এরপর বিকেলে ইয়াছিন লোকজন নিয়ে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। ওই সময় তাদের কারও ছুরিকাঘাতে ইয়াছিন মারা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে ইয়াছিনও আবদুল আহাদের অনুসারী হিসেকে কাজ করতেন। তবে ইয়াছিন কয়েক মাস আগে তাঁদের পক্ষ ছেড়ে যান। মাদক ব্যবসার সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও তাঁর দাবি, ইয়াছিন কিছুদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা করছিলেন।
এ ঘটনার বিষয়ে নগর ছাত্রলীগের উপসম্পাদক আবদুল আহাদের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর মুঠোফোন এ সময় বন্ধ পাওয়া যায়।
বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আল মদিনা হোটেল ফাঁকা পড়ে আছে। হোটেলের ব্যবস্থাপকসহ কর্মীদের কেউ নেই। সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছেন। উৎসুক লোকজনও ভিড় করেছে। হোটেলের মেঝে থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানান পাশের দোকানদারেরা।
সন্ধ্যায় হাসপাতালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, ইয়াছিন ও হারুন একসঙ্গেই থাকতেন। কিছুদিন আগে কোনো একটা বিষয়ে তাঁদের দ্বন্দ্ব হয়। আজ (কাল) সকালে কলেজে তাঁদের ঝগড়া হয়। এ ঘটনার জের ধরে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর চড়াও হয়। ফাহিম নামের আহত ওই যুবককে খোঁজা হচ্ছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদক ব্যবসা অন্যতম কারণ হতে পারে। হারুনের সঙ্গে ইয়াছিনের এ নিয়েই সম্ভবত দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
ইয়াছিনের পরিবারের সদস্যরা নগরের ডিসি রোড এলাকায় থাকেন। অবশ্য ইয়াছিন রেয়াজউদ্দিন বাজারের চৈতন্য গলি এলাকার একটি মেসে থাকতেন। হারুন নগরের নন্দনকানন এলাকায় থাকেন। ইয়াছিনের মতো হারুনের বাড়ি সাতকানিয়ায়।
ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন ইয়াছিনের বাবা কামাল উদ্দিন, চাচা আবছার উদ্দিনসহ স্বজনেরা। কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে ছাত্রলীগ করত জানি। কিন্তু তাই বলে এভাবে কেন মেরে ফেলা হলো?’
কামাল উদ্দিন অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত উল্লেখ করে ইয়াছিনের চাচা আবছার উদ্দিন বলেন, ‘আমার ভাই এবং আমরা কেউ বিএনপি কেউবা জামায়াতের রাজনীতি করি। আমার ভাইপো (ইয়াছিন) আওয়ামী লীগ করত। রাজনীতি তো দেশের উন্নতির জন্য। কেন হত্যা করা হলো তাকে?’
এদিকে হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে গতকাল বিকেলে হাসপাতালে ভিড় করেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী। কাছাকাছি এ সময় হাসপাতালের সামনের সড়কে কয়েকজন যুবক একটি গাড়ি (প্রাইভেট কার) ভাঙচুর করেন। ওই যুবকদের পরিচয় সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। এ ঘটনার পর হাসপাতাল এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ইমরান আহমেদ বলেন, ইয়াছিন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। নগর কমিটির নেতা আহাদের মাধ্যমে ইয়াছিনকে চিনতেন তিনি। আহত হারুনকে চেনেন না জানিয়ে তিনি বলেন, কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তা বুঝতে পারছেন না তাঁরা। তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।