কানাডার আদালত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাননি

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাননি কানাডার টরন্টোর এক আদালত। তাই কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে নির্দোষ রায় দিয়ে খালাস দিয়েছেন ওই আদালত। গত শুক্রবার স্থানীয় সময়ে এই রায় দেওয়া হয়।
এই রায়ের ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক, তা থেকে বাংলাদেশ দায়মুক্তি পেল। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে ২০১২ সালে এ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। অভিযোগ ছিল, কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। এতে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা ও এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা জড়িত। ওই সময় রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে (আরসিএমপি) এই খবর জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিভাগ। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। শুক্রবার মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী ভূঁইয়া।
প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত ঘোষণার এক দিন আগেই নিজস্ব অর্থায়নে এই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হচ্ছে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এই পর্যন্ত ৪০ শতাংশের মতো বাস্তবায়িত হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশ হিসেবে আমাদের জন্য সুসংবাদ; সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। এত দিন ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে যে আলোচনা, তোলপাড়, বিতর্ক হয়েছে, এর অবসান হলো।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক তদন্ত করল। বাংলাদেশে তদন্ত দল পাঠাল। সেই দলের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযোগ অব্যাহত রাখল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণের আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে শাস্তি দিয়ে ফেলল বিশ্বব্যাংক। এখন আদালতে প্রমাণ হয়েছে, দুর্নীতি হয়নি। তাহলে সরকারের উচিত, এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে জবাব চাওয়া।’
এই বিষয়ে জানতে গতকাল শনিবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে কান্ট্রি ডিরেক্টরের একটি বিবৃতি পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকে। যখনই এসব বিষয়ে তদন্ত শেষ করে বিশ্বব্যাংক, তখনই তদন্তের তথ্য-উপাত্ত ওই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়। ওই দেশের আইনের ব্যত্যয় হয়েছে কি না—এই স্বার্থেই বিশ্বব্যাংক তদন্তের তথ্য-উপাত্ত দেয়। তবে বিবৃতিতে শুক্রবারের রায় নিয়ে সরাসরি কিছু বলা হয়নি।

আদালতের রায়
এদিকে কানাডায় দায়ের করা ওই মামলার প্রমাণ হিসেবে রয়্যাল কানাডীয় মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) অভিযুক্ত ব্যক্তিদের টেলিফোনে আড়ি পাতার রেকর্ড আদালতে জমা দিয়েছিল। কানাডার টরন্টো স্টার পত্রিকার গত শুক্রবারের অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে, শুক্রবার কানাডার আদালত আদেশ দেওয়ার সময় টেলিফোনে আড়ি পেতে পাওয়া যেসব প্রমাণ দাখিল করা হয়েছিল, সেগুলো নাকচ করে দেন আদালত। সেই সঙ্গে এভাবে প্রমাণ সংগ্রহ করে তদন্ত কার্যক্রমের সমালোচনা করা হয়। কানাডার সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নর্দেইমার এ রায় দেন।
টরন্টো স্টার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী রায়ের আদেশে বিচারক লেখেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক অভ্যন্তরীণ চারজন গোপন সংবাদদাতার খবরের ভিত্তিতে এই অভিযোগ এনেছে বলে আদালতে জমা দেওয়া আবেদনে আরসিএমপি উল্লেখ করেছে। এই চারজনের মধ্যে মূলত আরসিএমপি একজনের বক্তব্যকেই আমলে নিয়েছে। বাকি তিনজনের সঙ্গে তারা কখনো কথাও বলেনি, এমনকি কোনো ধরনের তদন্তও করেনি। আর এই একজনের সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলেছে। আদালতের ভাষ্য, উপস্থাপিত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, সব না হলেও অধিকাংশ তথ্যই ‘২ নম্বর তথ্যদাতা’র কাছ থেকে সংগৃহীত। কিন্তু পুলিশ কখনোই এই তথ্যদাতাদের সঙ্গে কথা বলেনি কিংবা তাঁদের ব্যাপারে খোঁজখবর করেনি। আবার ২ নম্বর তথ্যদাতা আসলে এই প্রকল্পের একজন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। তিনি নিজেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের উল্লিখিত কাজের দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন এবং কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন।
টরন্টো স্টার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কানাডার ওই আদালতের রায়ে আরসিএমপির তদন্ত কার্যক্রমে এভাবে আড়ি পেতে ব্যক্তিগত আলাপন রেকর্ডটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করার সমালোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরসিএমপি কর্তৃপক্ষ আদালতে বলেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পেতে কেভিন ওয়ালেসসহ তিনজন দুবাইয়ে বৈঠক করেছেন এবং তাঁরা কানাডার পিয়ারসন বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (সিবিএসএ) বলেছে, ওই সময় কেভিন ওয়ালেস দুবাই যাননি।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কানাডার আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হলো, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণের অভাবে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগটি প্রমাণ করা যায়নি।

প্রতিক্রিয়া
পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কানাডার আদালতের এই রায় প্রমাণ করে, পদ্মা সেতু নিয়ে আমাকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করেছে, তা সর্বৈব মিথ্যা।’
পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় সাবেক সেতুসচিব ও বর্তমান শিল্পসচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে সেই সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিন পান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছু করব কি না। আমি মনে করি সেটার আর প্রয়োজন হবে না। কারণ বিশ্বব্যাংকের শিক্ষা অনেক আগেই হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে না থাকতে পারাটা তাদের জন্য বিরাট ক্ষতি, এটা তারা স্বীকারও করেছে। এ জন্য ওই সময়ে থাকা অনেকের চাকরিও গেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিশ্বব্যাংক, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসের কড়া সমালোচনা করেছেন। এই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছিল বলে যেসব সমালোচনাকারী সরব হয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানান জয়। তিনি আরও লেখেন, ‘বিশ্বব্যাংক মনগড়া প্রমাণ হাজির করেছিল। আমি নিজে এসব প্রমাণপত্র দেখেছি। এগুলো একেবারে বানানো। কোনো কিছুরই বিশদ প্রমাণ নেই। একটা অজানা সূত্রের কথা বলা হয়েছিল। যার নাম কখনো প্রকাশ পায়নি। এমনকি কানাডার আদালতও তা খুঁজে পাননি।’