'সমৃদ্ধি' চরের কথা

নিজের গরুর পরিচর্যা করছেন ফেরদৌসী বেগম। ছবি: প্রথম আলো
নিজের গরুর পরিচর্যা করছেন ফেরদৌসী বেগম। ছবি: প্রথম আলো

নিঝুম দ্বীপ পর্যটকদের হাতছানি দেয়। কিন্তু রাতে থাকবে কোথায়? কতটা নিরাপদ? খাবার পাওয়া যাবে তো? এ ধরনের অনেক প্রশ্নের সমাধান সেলিনা আক্তারের বাড়ি। তাঁর বাড়ি পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। কেউ যদি চিংড়ি বা শুঁটকি খেতে চায়, বনে গিয়ে একটু হরিণ দেখা বা সমুদ্রসৈকতে যেতে চায়, তারও ব্যবস্থা করবেন সেলিনা ও তাঁর পরিবার। নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের নামার বাজারে সেলিনার বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘ইকোট্যুরিজম’।

সরকারের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ‘দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে দরিদ্র পরিবারসমূহের সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি (সমৃদ্ধি)’ কর্মসূচির আওতায় নেওয়া ঋণ দিয়ে সেলিনা ঘরের চালে সোলার লাগাবেন। ঘরের পরিধি বাড়ানোসহ তাতে পর্যটকদের থাকার উপযোগী আসবাবপত্র কেনাসহ অন্যান্য কাজগুলোতে হাত দেবেন বলে জানালেন। এর মধ্যে একটি পর্যটক পরিবার সেলিনা আক্তারের বাড়িটি উদ্বোধনও করে ফেলেছে।

গত ১৮ জানুয়ারি নিঝুম এই দ্বীপে পাওয়া গেল আফরোজা বেগমকে। তিনি প্রিন্টের পরিচ্ছন্ন সুতির একটি শাড়ি পড়েছেন। ছোট টিনের ঘর। গরু ও ছাগল পালেন। ছেলের জন্য একটি রিকশা পেয়েছেন। আফরোজা বেগম একসময় ভিক্ষা করলেও এখন আর করেন না।

মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের কূলে দ্বীপটির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বাগানে একটি সবুজ রঙের টিউবওয়েল, তার চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা জায়গা। এ জায়গায় নারীরা গোসল করবেন। এতে সমৃদ্ধি কর্মসূচির পাশাপাশি কমিউনিটিরও অংশগ্রহণ আছে।

পিকেএসএফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ১১১টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে নিঝুম দ্বীপসহ ১৫০টি ইউনিয়নে ৯ দশমিক ৫২ লাখ খানায় সমৃদ্ধি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ খানাগুলোর মোট জনসংখ্যা ৪২ দশমিক ৩৯ লাখ।

নিজের বাগান থেকে শিম তুলছেন বিলকিস বেগম। ছবি: প্রথম আলো
নিজের বাগান থেকে শিম তুলছেন বিলকিস বেগম। ছবি: প্রথম আলো

গত ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পিকেএসএফের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের নাঙ্গুলিয়া চর, নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহীসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে যায়। এ প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরাও।

পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বলছে, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না। পিকেএসএফ এ কর্মসূচিতে এলাকা ও পরিবারভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘উপযুক্ত ঋণ’ দিচ্ছে। কেউ যদি গরু কিনতে চান, আর তাঁকে ১০ হাজার টাকা ঋণ দিলে শুধু গরুর পা কেনা সম্ভব, গরু তো আর কেনা যাবে না।

হাতিয়া সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত নিঝুম দ্বীপে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসতি। নিঝুম দ্বীপে সমৃদ্ধি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সহযোগী সংগঠন দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা। সংস্থার প্রধান নির্বাহী রফিকুল আলম জানালেন, কর্মসূচির আওতায় ৪০টি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুবিধা পাচ্ছে শিশুরা। কিন্তু এরপরে কাছাকাছি বিদ্যালয় না থাকায় তারা আর স্কুলে না গিয়ে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই চলতি বছরে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একটি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সব ওয়ার্ডেই বিশেষায়িত এ ধরনের কেন্দ্র তৈরি হবে।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহী ইউনিয়নে সমৃদ্ধি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। এই ইউনিয়নের সবাই ১০০ টাকা দিয়ে পুরো পরিবারের এক বছরের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড দিয়ে বিভিন্ন সেবা পাচ্ছে। শিক্ষা কর্মসূচিতে সব শিশুর আছে সমান অংশগ্রহণ। পিকেএসএফ বলছে, ১৫০টি ইউনিয়নে এ পর্যন্ত ৫৪৮টি সমৃদ্ধি কেন্দ্র ও ১ হাজার ৮১৫টি সমৃদ্ধি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। পিকেএসএফ চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দ্বীপ ও চরে লবণাক্ততা বড় সমস্যা।

সেলিনা আক্তারের ইকোট্যুরিজম বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো
সেলিনা আক্তারের ইকোট্যুরিজম বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো

হাতিয়ার চানন্দী ইউনিয়নের চরনাঙ্গুলিয়ায় সমৃদ্ধির আদলে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এ চরের ফেরদৌসী বেগমের ঘরের চালে ৪০টি কবুতরের বাকবাকুম ডাক। টিনের চালে সোলার লাগানো। বরাদ্দ পাওয়া জমিসহ বর্তমানে তাঁর জমির পরিমাণ ২৮০ শতক। গরু চারটি, ছাগল ১৪টি, হাঁস ৩০টি এবং মুরগি আছে ১০০টি। পুকুরে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ে পেয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ। বাড়ির আঙিনায় পেঁপে, তেঁতুলসহ নানান ধরনের ফলের গাছ। কথা বলতে বলতে বললেন, ‘ওই যে আমার ধানের খেত।’ তিনি জানালেন, লবণ, তেল ছাড়া বেশির ভাগ জিনিস কিনতে হয় না। সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে হাতে থাকে এক লাখ টাকার বেশি। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে পড়াশোনা করছে।

বিলকিস বেগমের আদর্শ বাড়িতে বসানো নলকূপের দেখভাল করেন তিনি। এলাকার নারী-পুরুষ নির্দিষ্ট সময় এসে সেখানে গোসল করেন। তাঁর বাড়িতেই বসে একটি কিশোরী ক্লাবের আসর। বাড়ির পাশেই একটি নার্সারি। বাড়ির চারপাশে বিশেষ সর্জন পদ্ধতিতে শিমের বাগান ও মাছের চাষ করেছেন। গত বছর ৪০ হাজার টাকার শুধু শিমই বিক্রি করেছেন। তাঁর এক মেয়ে, তিন ছেলে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেবেন না বলে উল্লেখ করে বললেন, ‘কম বয়সে বিয়া দিলে মাইয়্যা ছুত করি মইরা যাইব।’

নিঝুম দ্বীপে সমৃদ্ধি শিক্ষা কেন্দ্রে শিশুরা পড়াশোনা করছে। ছবি: প্রথম আলো
নিঝুম দ্বীপে সমৃদ্ধি শিক্ষা কেন্দ্রে শিশুরা পড়াশোনা করছে। ছবি: প্রথম আলো

সুলতানা বেগম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর বাড়িতেই দুজন প্যারামেডিক এলাকার নারীদের নিয়ে বসেছেন স্বাস্থ্য-কথা বলতে। গর্ভকালীন পাঁচটি বিপদচিহ্নসহ নানান বিষয়েই নারীরা সচেতন তা তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল।

তবে এত কিছুর পরও চরগুলোতে বাল্যবিবাহের হার এখনো বেশি। চরে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাবে গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মরতে হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত থেকে যাচ্ছে অসংখ্য শিশু।

নিঝুম দ্বীপসহ বিভিন্ন চরের মানুষের আতঙ্ক মেঘনা নদী। কয়েকবার করে নদীভাঙনের শিকার মানুষের বসতির খুব কাছেই আবার নদী চলে এসেছে। তাই সরকারের কাছে তাদের একটি বাঁধের আহ্বান।