ভোলার লালমোহন উপজেলার চতলা মোহাম্মদীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিসরুমে অন্য শিক্ষকের সামনে সহকারী প্রধান শিক্ষককে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা।
অভিযোগ উঠেছে, প্রধান শিক্ষক তাঁর ভাই ছাত্রলীগের নেতাকে দিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষককে পিটিয়েছেন। নোট ও গাইড-বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি এবং কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে এই বিরোধের সূত্রপাত বলে জানিয়েছে স্থানীয় ছাত্র ও অভিভাবকেরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ চলছে। তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বিদ্যালয় বন্ধ রেখেছে। এসব ঘটনা গত বুধ ও গতকাল বৃহস্পতিবারের। আহত সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ফিরোজ কিবরিয়া লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আছেন।
লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, রোগীর শরীরে একাধিক লাল দাগ। লাঠি অথবা রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। অনেক স্থানে ফোলা থাকলেও কাটে-ফাটেনি। প্রেশার বাড়তি হলেও বিপদমুক্ত।
উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চতলা মোহাম্মদীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২৫ জন ছাত্র, অভিভাবক ও প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই। তিনি সারা বছর বিদ্যালয়ে কোচিং-বাণিজ্য করেন। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মাসে ৭০০ টাকা এবং অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১ হাজার টাকা করে নেন। প্রধান শিক্ষক এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণের জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া কোচিং করার জন্য মাসে ১ হাজার করে তিন মাসে ৩ হাজার টাকা, মিলাদে ৫০০ টাকা ও প্রবেশপত্র বাবদ ৯০০ টাকা নিয়েছেন।
এলাকাবাসী বলেন, প্রধান শিক্ষক যে কোম্পানির ঘুষ গ্রহণ করেছেন, সেই কোম্পানির বই ছাত্রছাত্রীদের কিনতে না বলায় প্রধান শিক্ষক সহকারী প্রধান শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে গত বুধবার দুপুরে ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক তাঁর আপন ভাই ছাত্রলীগের নেতা মো. বেলাল হোসেনকে মুঠোফোনে খবর দিয়ে বিদ্যালয়ে আনেন। বেলালের নেতৃত্বে ১০-১২ জন সন্ত্রাসী রড-লাঠি দিয়ে বিদ্যালয়ের অফিসরুমে সহকারী প্রধান শিক্ষককে বেধড়ক পিটিয়ে ফেলে যায়। পরে স্থানীয় যুবলীগের নেতা মো. সোহাগ চান তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ঘটনায় বুধবার বিকেলে মো. সোহাগ চানের নেতৃত্বে ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক ও এলাকাবাসী বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিদ্যালয় বন্ধের ডাক দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সহকারী প্রধান শিক্ষককে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফিরোজ কিবরিয়া বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ঘুষ নিয়েছেন পুঁথি নিলয় কোম্পানির কাছ থেকে। সেটি আমাদের বলেননি। বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া বই বিক্রি করেছেন। তাই আমি ছাত্রছাত্রীদের ভালো কোম্পানির বই কিনতে বলেছি। এতেই আমি শত্রু। আমাকে প্রধান শিক্ষকের ভাই মো. বেলাল হোসেন ও একদল সন্ত্রাসী অফিসরুমে শিক্ষকদের সামনে রড দিয়ে পিটিয়ে ফেলে রেখে যায়।’
ধলীগৌরনগর ইউনিয়নে ছাত্রলীগের দুটি কমিটি—উত্তর আর দক্ষিণ। দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমি রাজনীতি ও শিক্ষকতা করি। আমি ধলীগৌরনগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণ চতলা আদর্শ মহিলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক। আমি মো. ফিরোজ কিবরিয়া স্যারকে পিটিয়ে জখম করিনি। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন ফিরোজ স্যারের কথা-কাটাকাটি হয়েছে।’
চতলা মোহাম্মদীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই বলেন, ‘এটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক সমিতি মিল করে দিচ্ছে। আমি আমার ভাইকে (বেলাল হোসেন) দিয়ে পেটাইনি। তবে আমার ভাই উপস্থিত ছিল। যারা পিটিয়েছে, তাদের ফিরোজ স্যার চেনেন।’
বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. বাচ্চু মাতব্বর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘চলতি নিয়োগে সরকার বিদ্যালয়ে চারজন নতুন শিক্ষক দিয়েছেন। তাঁরা নিয়মিত ক্লাস করেন। এর ফলে প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন পুরোনো শিক্ষক বিরোধিতা করছেন, কারণ তাঁরা থাকলে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য কম হচ্ছে।’
লালমোহন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে বিভাগীয় তদন্ত হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামসুল আরিফ বলেন, প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই কেন সহকারী প্রধানকে পেটালেন, তার লিখিত জবাব চাওয়া হয়েছে। সেটি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।।
উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি আফছার উদ্দিন বলেন, ‘দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। একসঙ্গে চাকরি করবে।’