ঠেঙ্গারচর থেকে জালিয়ারচর

নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরের অনেক এলাকা প্লাবিত হয় জোয়ারের পানিতে। ছবিটি ১২ ফেব্রুয়ারি তোলা l প্রথম আলো
নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরের অনেক এলাকা প্লাবিত হয় জোয়ারের পানিতে। ছবিটি ১২ ফেব্রুয়ারি তোলা l প্রথম আলো

হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ঠেঙ্গারচরের দূরত্ব নদীপথে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। ট্রলারে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। জোয়ার এলে ডুবে যায় চরের বেশির ভাগ এলাকা। চরে দস্যুদের আনাগোনা থাকতে পারে। জেলেদের কাছে এই চর গাঙ্গুরিয়ারচর নামেও পরিচিত। হাতিয়া পৌরসভার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে ঠেঙ্গারচর সম্পর্কে এতটুকুই জানা গেল।
এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় হাতিয়ার নলচিরাঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় (ট্রলার) করে যাত্রা ঠেঙ্গারচরের উদ্দেশে। চরে দস্যুদের কবলে পড়লে আক্রমণ ঠেকাতে নিরাপত্তার জন্য ঘাট থেকে নৌপুলিশের দুই কনস্টেবল সঙ্গী হলেন। শীতের সকালে জোয়ারের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রলার ছুটে চলে ঠেঙ্গারচরের উদ্দেশে।
ট্রলারে থাকতেই মুঠোফোনে বন বিভাগের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেল আরও কিছু তথ্য। চরের আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর। এ চরে সরকারিভাবে বনায়ন শুরু হয় ২০১০-১১ সালে। ইতিমধ্যে ৪ হাজার ৮০০ একর জমিতে বনায়ন করা হয়েছে।
যাত্রার সোয়া দুই ঘণ্টা ট্রলার চলার পর দেখা মিলল সেই কাঙ্ক্ষিত চরের। চরের তীরের অবস্থা দেখে হোঁচট খাওয়ার জোগাড়। বহু কষ্টে কাদা মাড়িয়ে চরের বুকে পা রাখলেও হাঁটা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্য ও ট্রলারের মাঝি চরে হাঁটার কৌশলটা দেখিয়ে দেওয়ায় কিছুটা রক্ষা। প্রায় আধা ঘণ্টা চরের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ঘুরেও শুকনো মাটি দেখা পাওয়া গেল না।
এই চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে—এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে ট্রলারে উঠে আবার নদীপথে চরের চারদিক ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত হলো। এ সময় আরেকটি নৌকা দেখা যায়। এ নৌকায় ছিলেন চারজন। তাঁরা কাঁকড়া শিকারি। বাড়ি হাতিয়ার চরকিংয় এলাকায়। তাঁদের একজন পিন্টু চন্দ্র দাসের সঙ্গে আলাপ। আলাপের একপর্যায়ে জানালেন, এই চরে নয়, তাঁরা শুনেছেন মেঘনার জালিয়ারচরে রোহিঙ্গাদের জায়গা দেওয়া হবে। সেখানেই কয়েক দিন আগে সরকারি বড় কর্মকর্তারা ঘুরে গেছেন। ওই চরটির নামও ঠেঙ্গারচর বলে জানান তিনি।
কাঁকড়া শিকারি পিন্টু চন্দ্র দাসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নতুন গন্তব্যের দিকে আবার যাত্রা শুরু। শুরুতে ট্রলারের সারেং (মাঝি) রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অনেক বলে-কয়ে তাঁকে রাজি করানো হলো। ঠেঙ্গারচর থেকে জালিয়ারচরের দূরত্ব হবে ১৪-১৫ কিলোমিটার। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা ট্রলার চলার পর দেখা মিলল জালিয়ারচরের। দূর থেকে দেখতেই চরটিকে বেশ উঁচু মনে হলো। কাছে যাওয়ার পর আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে চরের ভূখণ্ড উঁচু। চারদিকে ঘন বন। দুপুর ১২টার দিকে চরের মাটিতে পা রাখতেই চারদিকে বনের সবুজ গাছ চোখে পড়ে। চরটি দেখে সহজেই বোঝা যায় এটি অনেক পুরোনো। মাটিও অনেক শক্ত। প্রায় এক ঘণ্টা চরের নানা দিকে ঘুরে দস্যুদের কাটা বেশকিছু গাছের গুঁড়িও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। চোখে পড়ে একটি খাল। সেখানে পরিযায়ী পাখিসহ নানা প্রজাতির পাখি রয়েছে।
চরের খালে মাছ শিকার করতে আসা হাতিয়ার জাহাজমারা এলাকার জগেশ চন্দ্র দাস, আলাউদ্দিন, আলী আহম্মদসহ ছয়-সাতজন জেলে প্রথম আলোকে বলেন, ২০-২২ বছর আগে এই চরটি জেগে উঠতে দেখেন তাঁরা। এটি শুরুতে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি ছিল। চরটি এরই মধ্যে বসবাসের উপযোগী হয়েছে বলে দাবি করে তাঁরা বলেন, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চরের চারপাশে উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা ছাড়াও চরটিকে চাষাবাদ উপযোগী করতে হবে। রোহিঙ্গাদের এই চরে স্থানান্তর করার কথা তাঁরা লোকমুখে শুনছেন।
বন বিভাগের নথি অনুযায়ী, মেঘনা নদীতে ১৯৯০ সালের দিকে জালিয়ারচর জেগে ওঠে। ১৯৯৮ সাল থেকে সেখানে সরকারিভাবে বনায়নও শুরু হয়। হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে জালিয়ারচরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। চরের অবস্থান হাতিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে। এই চরে ভূমির পরিমাণ কত, সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্য হাতিয়া উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়ে নেই। বন বিভাগের কর্মকর্তারাও চরের আয়তন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। অবশ্য চরে বিভিন্ন সময়ে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের দাবি অনুযায়ী, চরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় চার মাইল, প্রস্থে প্রায় আড়াই মাইল। হাতিয়া থেকে বড় ট্রলারে করে চরে পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে। মাঝারি আকৃতির ট্রলারে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। শীত মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময়ে নদীপথে এই চরে যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান জেলেরা।
নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমির হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঠেঙ্গারচর অপেক্ষাকৃত নতুন চর। চরে বনায়ন করা হচ্ছে। ঠেঙ্গারচরের উত্তর-পূর্ব দিকে আরও একটি চর আছে। নাম জালিয়ারচর। এটি অনেক পুরোনো চর। বনায়ন করা হয়েছে প্রায় ১৮ বছর আগে। গাছগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। চরের জমিও কৃষির উপযোগী হয়ে যাওয়ার কথা।
চরের নাম নিয়ে জটিলতার বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, হাতিয়ার আশপাশের চরগুলোর প্রতিটিরই একাধিক নাম রয়েছে। ঠেঙ্গারচরেরও একাধিক নাম রয়েছে। কেউ এটাকে বলে ভাসানচর, কেউ বলে জালিয়ারচর। যে নামই হোক, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য এই চরটিকে নির্বাচন করা হয়েছে।