রোগীর স্বজনদের মারধর, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি

জরুরি বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে ফটকে অবস্থান নেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ছবি: সোয়েল রানা
জরুরি বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে ফটকে অবস্থান নেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আজ রোববার ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এক মুমূর্ষু রোগীর স্বজনদের দফায় দফায় মারধর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়া ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা বেলা একটা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত এই ঘটনা চলার সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক তালা ঝুলিয়ে আটকে রাখেন। পরে পাল্টা অভিযোগ করে সাত দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেন তাঁরা।

হামলার শিকার রোগীর একজন স্বজন আবদুর রউফ। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কোনাগাতি গ্রামে। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অডিটর পদে হবিগঞ্জ জেলায় চাকরি করেন। রউফ প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর বাবা আলাউদ্দিন সরকার (৬০) মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শনিবার রাতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। হাঁপানির সমস্যা থাকায় আলাউদ্দিনের শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। রোববার দুপুর ১২টার দিকে রউফ কর্তব্যরত এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে বৈদ্যুতিক পাখার সুইচ কোথায় জানতে চান। ওই চিকিৎসক তাঁকে সুইচ খুঁজে নিতে বলেন। খুঁজে পাচ্ছেন না জানালে চিকিৎসক রেগে গিয়ে বলেন, ‘আমি কি আয়া? এই রুমে থাকি?’ এ সময় আসিফ নামে আরেক ইন্টার্ন চিকিৎসক ‘ডাক্তারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছিস কেন?’ বলে রউফের কলার চেপে ধরেন। প্রতিবাদ করলে তাঁকে কিলঘুষি মারতে মারতে হাসপাতালের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। রউফের অভিযোগ, সেখানে চিকিৎসকেরা কয়েক দফায় তাঁকে পেটান। তাঁকে পায়ে ধরে মাফ চাইতেও বাধ্য করা হয়। রউফ আরও বলেন, সবার সামনে ১০০ বার কান ধরে ওঠবস করার পরও তাঁকে মারধর করা হয়। এ সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।

জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকায় নিরুপায় স্বজনেরা এক রোগীকে বাইরে চেয়ারে শুইয়ে রেখেছেন। ছবি: সোয়েল রানা
জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকায় নিরুপায় স্বজনেরা এক রোগীকে বাইরে চেয়ারে শুইয়ে রেখেছেন। ছবি: সোয়েল রানা

তবে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অভিযোগ, ডা. আসিফ নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের ওপর রউফ হামলা করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদেই জরুরি বিভাগ বন্ধ রেখে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
বিকেল চারটার দিকে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ আহসান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা আলম, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল আলম, অন্যান্য জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে রউফের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এই বৈঠকের পরে রউফকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
এর মধ্যে রউফকে আটকে রাখার খবর পেয়ে রোগীর সঙ্গে আসা তাঁর বোন বীণা বেগম এবং শ্যালিকা সেতু এসে পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে চান। বীণা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এভাবে আমার ভাইকে মারধর করা হচ্ছে কেন? মন্ত্রী নাসিম সাহেবকে এটা জানাব।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সঙ্গে সঙ্গে পরিচালকের সামনেই ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা রউফকে আবার মারতে থাকেন। তাঁরা বীণা ও সেতুকেও মারধর করেন।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী অভিযোগ করেন, আবদুর রউফের ওপর হামলা, দুই নারীকে লাঞ্ছনা এবং হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন কুতুব উদ্দিনসহ ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা।

তবে কুতুব উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ইন্টার্ন ডাক্তারদের সঙ্গে অসদাচরণ ও তাঁদের ওপর হামলা চালানোয় জরুরি বিভাগ বন্ধ করে সাত দফা দাবিতে প্রতিবাদ করা হয়েছে। পরে পরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের অনুরোধে বিকেল সাড়ে ৩টার পর জরুরি বিভাগ খুলে দেওয়া হয়। রউফকে কেন মারধর করা হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, রউফ চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধর করেছিলেন।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ আহসান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রোগীর দুর্ভোগ বিবেচনা করে বিষয়টি মিটমাট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময় রউফকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সামনে ডেকে এনে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা তাঁকে কান ধরে ওঠবস করার নির্দেশ দিলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে সেখান থেকে চলে আসি।’ পরে সন্ধ্যায় পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের মারধর করায় রউফের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা যাতে কর্মবিরতিতে না যান সে জন্যও আলোচনা চলছে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে রউফকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। চিকিৎসকেরা মামলা দিলে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

রোগীদের দুর্ভোগ:
জরুরি বিভাগ বন্ধ রেখে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি পালন করায় রোগীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামের ৮৮ বছরের আব্দুল জব্বার মণ্ডল স্ট্রোক করায় তাঁকে এ হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু জরুরি বিভাগ বন্ধ রেখে চিকিৎসকেরা ধর্মঘট পালন করায় বিপাকে পড়েন তাঁর স্বজনেরা। জব্বার মন্ডলের ভাগনে আব্দুর রহিম বলেন, তাঁর মামাকে অ্যাম্বুলেন্স করে জরুরি বিভাগের সামনে নিয়ে সেখানকার ফটকে তালা ঝুলতে দেখেন। তিনি অভিযোগ করেন, এ সময় কয়েকজন তেড়ে আসেন। বাধ্য হয়ে তারা মামাকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেন।
বেলা একটা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এমন প্রায় অর্ধশত গুরুতর রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ফেরত পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব রোগীকে পরে শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।