আরও মৃত্যু, আরও আর্তনাদ

ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনকার প্রাণান্ত পরিশ্রম থেকে ‘মুক্তি’ মিলেছে শিরিন আক্তারের স্বামী ট্রাফিক কনস্টেবল ফাইজুল ইসলামের। কিন্তু স্বামীর এমন অবসর যে তাঁর কাছে দুঃস্বপ্ন। গত মঙ্গলবার রাতে বাংলামোটর এলাকায় পেট্রলবোমা হামলায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিত্সা নিচ্ছেন ফাইজুল। এক স্বজনকে স্বামীর খবর জানাতে গিয়ে কাঁদছেন তিনি । প্রথম আলো
ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনকার প্রাণান্ত পরিশ্রম থেকে ‘মুক্তি’ মিলেছে শিরিন আক্তারের স্বামী ট্রাফিক কনস্টেবল ফাইজুল ইসলামের। কিন্তু স্বামীর এমন অবসর যে তাঁর কাছে দুঃস্বপ্ন। গত মঙ্গলবার রাতে বাংলামোটর এলাকায় পেট্রলবোমা হামলায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিত্সা নিচ্ছেন ফাইজুল। এক স্বজনকে স্বামীর খবর জানাতে গিয়ে কাঁদছেন তিনি । প্রথম আলো

পুলিশের সদস্য ফেরদৌস খলিলের দগ্ধ লাশ দেখে স্তম্ভিত পুলিশের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বার্ন ইউনিটের ভেতরে দগ্ধ পুলিশের আরেক সদস্যসহ দুজনকে নিয়ে ব্যস্ত চিকিৎসকেরা। ঠিক তখনই দোতলার একটি কক্ষে দগ্ধ মাজেদুল ইসলামের লাশ ধরে চলছিল স্বজনদের আহাজারি। এ আর্তনাদ শেষ না হতেই বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে বের করা হলো আরেক দগ্ধ ট্রাকচালক নজরুল ইসলামের লাশ।
গত মঙ্গলবার রাতে বার্ন ইউনিটজুড়ে ছিল এমনই ভয়াবহ দৃশ্য। হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালে এমন ভয়াবহতা নতুন কিছু নয়। তবে বেশ কয়েক দিন হরতাল-অবরোধের আগুনে পোড়া রোগী আসা বন্ধ হওয়ায় কিছুটা প্রশান্তিতে ছিল পরিবেশ। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আবারও যোগ হয়েছে নতুন নতুন আর্তনাদ-যন্ত্রণা।
অবরোধ শেষ হওয়ার সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে পুলিশের রিকুইজিশন করা বাসে পেট্রলবোমা হামলায় নিহত হন ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল ফেরদৌস খলিল (৪২)। আর প্রায় একই সময়ে মারা যান বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাকচালকের সহযোগী মাজেদুল (২৫)। এর ঘণ্টা খানেক পর বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাকচালক নজরুলও (২৮) মারা যান। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ট্রাকচালক শাহিন শাহর।
বাংলামোটরের ওই ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হন আরেক ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল ফাইজুল ইসলাম (৩৮) ও চালক বায়েজীদ খান (২০)।
বুড়া মা-বাপরে দেখার কেউ রইল না: গত শনিবার রাতে ট্রাকে সবজি বোঝাই করে নওগাঁ থেকে কুমিল্লা যাচ্ছিলেন চালক মো. শাহীন ও সহযোগী মাজেদুল। ট্রাকটি সিরাজগঞ্জের বাইনাঘাতী এলাকায় পৌঁছালে কয়েকজন যুবক ইট ও পেট্রলবোমা ছোড়েন। আগুনে শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে যায় মাজেদুলের আর ৭০ ভাগ শাহীনের।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখা গেছে মাজেদুলের বোন মোছাম্মৎ সুমিকে। ঘটনার পর থেকেই ভাইয়ের পাশে ছিলেন তিনি। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমার বুড়া মা-বাপরে দেখার কেউ রইল না।’
শাহীনের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুর থানার বাঘাছড়া গ্রামে। চার ভাইবোনের মধ্যে শাহীন বড়। পরিবারের ভরণপোষণের প্রায় পুরোটাই ছিল তাঁর দায়িত্বে।
শ্বাসনালি পুড়ে গিয়েছিল নজরুলের: গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গত সোমবার রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আনসার একাডেমির পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে চালভর্তি চলন্ত ট্রাকে অবরোধ-সমর্থকদের ছোড়া পেট্রলবোমার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন চালক নজরুল। বোমায় নজরুলের শ্বাসনালিসহ শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে যায়। মঙ্গলবার রাত একটার দিকে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে তিনি মারা যান।
নজরুলের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। বাবা মৃত ফজর আলী। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়েই সংসার। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারও পড়ে গেছে ঘোর অন্ধকারে।
‘ফেরদৌস পুইড়া জানালায় আটকে ছিল’: বার্ন ইউনিটের দোতলায় দগ্ধ মুখ ও শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে বার্ন ইউনিটের বেডে শুয়ে আছেন বাংলামোটরে পেট্রলবোমায় আহত ট্রাফিক কনস্টেবল ফাইজুল। পাশে স্ত্রী শিরিন আক্তার। ফাইজুল বলেন, ‘আমি মাত্র বাসে উইঠা দরজার পাশের সিটে বসছি। কয়েক সিট পরে বসল ফেরদৌস। এর মধ্যে হঠাৎ মাঝখানে দুইটা বোমা পইড়া চারদিকে আগুন ধইরা যায়। আমরা দৌড় দেই। একটা সিটের সঙ্গে ধাক্কা খাইয়া পইড়া যায় ফেরদৌস। আমি “আল্লাহ” বইলা মুখ চাপা দিয়া বাইর হইয়া আসি। চোখ মেইলা দেখি, ফেরদৌস পুইড়া বাসের জানালায় আটকে আছে।’
১৯৯৭ সাল থেকে পুলিশে চাকরি করছেন ফাইজুল। স্ত্রী শিরিন দুই সন্তানকে নিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার হারবাইত গ্রামে থাকেন। কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছেন এত দিন। এমন অসহায় পরিণতিতে ভেঙে পড়েছে তাঁর পরিবার।
পুড়ে ছাই শেষ সম্বল: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিচতলায় ভর্তি আছেন পেট্রলবোমায় পুড়ে যাওয়া পুলিশের রিকুইজিশন করা বাসের চালক বায়েজিদ খান। বাবা-মা এবং এক ভাই ও বোন বাকেরগঞ্জে থাকেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তিনি।
বায়েজিদ প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি চালিয়ে জমানো টাকা, জমি বিক্রি ও ধারদেনা করে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওই বাসটি কিনেছিলেন। এক বছর ধরেই পুলিশ আনা-নেওয়ার কাজ করছেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাসেই ঘুমাতেন তিনি। আগুন শুধু জীবন শেষ করেনি, পুড়ে ছাই করে দিয়ে গেছে তাঁর পরিবারের একমাত্র সম্বল বাসটিকেও।