এখনো অবরুদ্ধ কয়েকটি গ্রাম, শিবিরের পাহারা

উত্তরের জেলা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার কুসুমবা ইউনিয়নের বাঁশখুর গ্রাম। গতকাল বুধবার দুপুরে গ্রামটিতে ঢোকার মুখে ৮-১০ জন যুবক আমাদের মোটরসাইকেল আটকে দেন। তারপর ঘিরে ধরেন।
কই যাবেন? কোথা থেকে এসেছেন? তাঁদের উদ্ধত প্রশ্ন। জবাবের অপেক্ষা না করেই পরের প্রশ্ন—সাংবাদিক না তো?
ফলাফল হলো—জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের এই তল্লাশি এড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামটিতে আর যাওয়া গেল না। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়াও চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে পাঁচবিবি বাজার থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটিতে। সেখানে নির্যাতিত সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কীভাবে দিনের পর দিন অবরুদ্ধ হয়ে আছেন, তা সহজেই অনুমেয়।
কুসুমবা ইউনিয়নের মতো অবস্থা পাঁচবিবি সদর, বাগজানা, মোহাম্মদপুর, সদর উপজেলার ভাদশা, আমদই ও পুরানাপৈল ইউনিয়নের। সেখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাহারা বসিয়েছেন দলটির কর্মীরা। পালা করে চলে সেই পাহারা। অনেক জায়গায় এই পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছে স্থানীয় কোনো কোনো মাদ্রাসার ছাত্রদের।
পাঁচবিবি বাজার ও জয়পুরহাট শহরে ফিরে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এলাকাবাসী জানালেন, অবরোধ শুরুর পর কুসমবা ইউনিয়নের কুসমবা, রুনিহালী, গোবিন্দপুর, মঠপাড়া, কাঁসরা গোবিন্দপুর, কোচপুকুরিয়া, সোনাইপুর, দহতপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের হাজার ছয়েক হিন্দু ও সাঁওতাল আদিবাসী এক মাস ধরে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর এখানকার ২০ থেকে ২৫টি হিন্দু বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। ভয়ে অনেকেই রাতে বাড়িতে থাকা ছেড়ে দিয়েছেন। একই অবস্থা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদেরও।
পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা বাজারের দুলাল চন্দ্র অধিকারীর ওষুধের দোকান, মাধব চন্দ্রের কসমেটিক ও সুনীল মহন্তের দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার আটাপুর ইউনিয়নের কোচপুকুরিয়া গ্রামের আদিবাসী শিক্ষক বিপুল চন্দ্র পাহান ও তাঁর ছোট ভাই ফুনি পাহানের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিপুল চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, আদিবাসীরাও এখন আতঙ্কে আছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানালেন, হিন্দুদের পাশাপাশি কুসমবা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেনের খড়ের পালায়, আওলাই ইউনিয়ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমের দোকানে, তেলিহারের আওয়ামী লীগের কর্মী দুলাল, বাবু, খলিল, সোনারপাড়ার কবি মাসুদার রহমান ও আবদুর রশিদ, বিনধারা গ্রামের মোহাম্মদপুর ইউপি সদস্য পিন্টু, তাহের, শিপন, পাপ্পু, ফারুক চৌধুরীর বাড়ি ও খড়ের পালায়, সরাইলে ফাইনুরের ট্রাকে এবং রায়গ্রাম বাজারের চার-পাঁচটি দোকানে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
পাঁচবিবি বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁরা বলেন, নাম প্রকাশ করলে আবার হামলা হবে। জানালেন, এত দিনেও তাদের অবস্থা দেখতে পুলিশ বা সরকারের কোনো লোকজন যায়নি, আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা তো দূরের কথা।
কাঁসরা গোবিন্দপুর গ্রামের অরুণ কবিরাজ বললেন, ‘আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ বাবাকেও মেরেছে। পুলিশও আমাদের এলাকায় যেতে সাহস করছে না। আমিও ভয়ে পাঁচবিবি বাজারে থাকি। এত হামলা হচ্ছে, পুলিশ-সরকার কেউ তো আসছে না।’
রুনিহালি গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বললেন, ‘একাত্তরে যাদের পরাজিত করেছিলাম, আজ তাদের ভয়ে পালিয়ে থাকতে হয়। হিন্দু বলে আতঙ্কের মধ্যে থাকি।’
পাঁচবিবি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গ্রামপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দুরা চরম আতঙ্কে আছেন। যেসব হিন্দু একটু অবস্থাশালী, তাঁরা গ্রামে যাচ্ছেন না। আমার নিজের বাড়িতেও ককটেল হামলা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রামে কখনো পুলিশও যেতে পারছে না।’
জয়পুরহাট জেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় হওয়ার পর গত মার্চে পাঁচবিবিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও দোকানপাটে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। এরপর কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হওয়ার পর আবার হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘুরা এখন চরম আতঙ্কে আছে।
পাঁচবিবি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জামায়াতের। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা জামায়াতের আমির তসলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের বাড়িঘরে জামায়াত-শিবিরের কেউ হামলা চালায়নি। এটা মিথ্যা অভিযোগ। তবে দু-একটি জায়গায় আমাদের অতি উৎসাহী কিছু নেতা-কর্মী হয়তো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালাতে পারে। আমরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
পাঁচবিবি ছাড়াও হামলার ঘটনা ঘটেছে জয়পুরহাট সদরের কিছু গ্রামে। ১৪ ডিসেম্বর রাতে সদর উপজেলার দুর্গাদহ কামার পল্লির কামারদের চারটি দোকান ঘরে আগুন দেওয়া হয়। দুর্গাদহ বাজারের কমল চন্দ্র ও শয়ন চন্দ্র, মাধাইনগর বাজারে নেপাল চন্দ্র ও প্রফুল্ল চন্দ্রের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়।
সদর উপজেলা হিচমী বাজারের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ব্যবসায়ী মো. আমানুল্লাহর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রাতে হামলা চালিয়ে ট্রাকে ও মাইক্রোবাসে অগ্নিসংযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। সদরের দোগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা এবং ওই ইউনিয়নের মেম্বার আইয়ুব হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁকে কোপানো হয়। পুরানাপৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলীর বাড়িতে এবং মাধাইনগরে পাঁচটি হিন্দু পরিবারের খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয়।
১১ ডিসেম্বর রাতে রানাপৈল বাজারের সুশীল চন্দ্র মণ্ডলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুদামঘরে আগুন দিয়ে এক-দেড় হাজার মণ পাট ও গদিঘর ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৫ ডিসেম্বর জামায়াতের ডাকা হরতাল ও ১৮ দলের অবরোধ চলাকালে পুরানাপৈলে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুন দেওয়া হয়। পুরানাপৈল পেট্রলপাম্পের কাছে রাস্তায় কাঠের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করা হয়। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি হালুট্টি গ্রামে গেলে তাদের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল হামলা হয়। পুলিশ গুলি ছুড়লে পাঁচজন মারা যায়। এর আগে সাঈদীর মামলার রায়ের পর একইভাবে মারা গিয়েছিল ছয়জন।
১২ ডিসেম্বর রাতে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল কেন্দ্রীয় ঈদগা মাঠের পাশের ওই কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের টিন এবং ভেতরের সব আসবাব পুড়ে গেছে। দুজন শ্রমিক মেরামতের কাজ করছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জয়পুরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক এস এম সোলায়মান আলী বললেন, ‘আমার বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাঁচবিবিতে এবং সদরের কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দুরা আতঙ্কে বাড়িতে থাকছেন না। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনুন।’
জয়পুরহাট পুলিশ সুপার হামিদুল আলম বলেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। ইতিপূর্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান চলছে। তিনি বলেন, এখন গ্রামেগঞ্জে যা চলছে, তা থেকে উত্তরণে দলমত, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।