আমার একুশে চিত্রাবলি

.
.

একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সেজন্য আমি গৌরবান্বিত। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের জন্য আমি পাঁচটি স্কেচ করেছিলাম ১৯৫৩ সালে। তখন একুশের ঘটনা যেভাবে আমার মনে রেখাপাত করেছিল, এসব তারই চিত্রাবলি। যদিও শিল্পগুণে এগুলোর শৈল্পিক মান নেই, তবু ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে অমূল্য বলে আমার ধারণা। তবে গুলিতে উড়ে যাওয়া রফিকের খুলি, মাথার মগজ সযত্নে স্টেশনের একপাশে রাখা ও সালামের গুলিতে ফাটা বাঁশের মতো হাঁ করা দৃশ্য ছিল এমনই হৃদয়বিদারক ও বিভীষিকাময়, যে সেটা আঁকিনি।

.
.

সকাল ১০টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, তখন ছাত্রজমায়েত তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—এ ব্যানার নিয়ে টুকরো টুকরো মিছিল ছাত্রদের বলিষ্ঠ পদধ্বনিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা মুখরিত করে তুলেছে। রাস্তায় পুলিশ ট্রাকভর্তি। রোদ তেতে উঠেছে মাথার ওপর। পুলিশের মাথায় গোল খাকিরঙা পশমি টুপি বেয়েই কাত করে পরা।
আমতলায় মিটিং শুরু হয়েছে। সবার চোখেমুখে ঠিকরে পড়েছে একটি প্রশ্ন—কী হবে, কী করব এখন। গুঞ্জন ছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। নেতারা বক্তৃতা দেন, এখন মিছিল করে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে যাওয়া মানেই গন্ডগোলের সম্ভাবনা, তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না। ছাত্ররা ক্ষেপে উঠল শুনে, চিৎকার করে বলে, বিশ্বাসঘাতক। আমরা ফিরব না। মিষ্টি কথা শুনতে আসিনি। ক্রুদ্ধ চিৎকার ও টিটকারিতে থেমে যায় বক্তার আওয়াজ।

.
.

এমন সময় জটলার ভেতর থেকে একজন সামনে রাখা টেবিলের ওপর উঠে বলেন, পাঁচ-দশজন করে বেরিয়ে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে যাবে। হাত ধরাধরি করে ছাত্ররা বেরিয়ে এল। এমন সময় হলো লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার পালা।
মেডিকেল হোস্টেলের ছাত্রাবাসের চারদিকে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো ছিল পাকিস্তান হওয়ার আগে গোড়া সৈনিকদের আবাসস্থল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এগুলো নির্মিত হয়েছিল। তার আগে সেখানে ছিল আমবাগান। এখানে অবাঙালি এক ফকির বাস করত। কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ, সারা গায়ে তেল চপচপে, তাই তার নাম ছিল তেলি শাহ। বর্তমানে মেডিকেল কলেজ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, পরে যুদ্ধের সময় রূপান্তরিত হয় হাসপাতালে। ব্যারাকগুলো ছিল পুব-পশ্চিমে সিঁথির মতো সরু লাল ইটের রাস্তার দুই ধারে সারি সারি। কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পুলিশের দিকে ছাত্ররা দিচ্ছে অনবরত স্লোগান, ‘এমএলরা বেরিয়ে আসো, সভ্যপদ থেকে পদত্যাগ করো।’

.
.

লাঠিচার্জে আহতদের অনেকে ধরাধরি করে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে চলল, কাউকে বা হাঁটু গেড়ে বসে ধরল। এগুলো ছিল গ্রন্থের জন্য স্কেচ। তবে সৃজনশীল হিসেবে প্রথমে আমি উল্লেখ করতে চাই ‘রক্তাক্ত একুশে’ চিত্রটি। লিনোকাটে উৎকীর্ণ এই চিত্রটির দুটি ভার্সন আমি করেছিলাম। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর তিন-চার মাসের মধ্যেই এ দুটি রচনা করি। এখন যেটা বহুল প্রচারিত, সেটা ছিল প্রথম রূপ। এই লিনোকাটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত গ্রন্থে ছাপা ছিল না। তবে দ্বিতীয় রূপটি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল।

.
.

দুই লিনোকাটের প্রধান পার্থক্য হলো—গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে যে ছাত্র ধরেছে, তার ডান হাতে প্ল্যাকার্ডটি থাকলেও দ্বিতীয় চিত্রটিতে তা নেই। তার জামার বুকপকেটে কলম, যা প্রথম চিত্রটিতে ছিল না। প্রথম ছবিটির ডান দিকের নিচে ‘এস’ ও ‘বি’ দুটি আদ্যক্ষর অর্থাৎ মুর্তজা বশীর একসঙ্গে খোদিত, কিন্তু অন্যটিতে নেই। তবে প্রথম ছবিটি আঁকতে গিয়ে যেভাবে লিনোকাটে আঁচড় ও অক্ষরের বিন্যাস করা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে তা অনুপস্থিত। মূলত আমার প্রকাশভঙ্গির সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরার জন্যই একই বিষয় ও ভঙ্গির দুইভাবে আঁকা হয়েছে। এই লিনোকাটের কম্পোজিশনকে সৈন্য ও ছাত্রজনতার মুখোমুখি লড়াইকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে সৈনিকের রূপ ঘোষণার জন্য বেয়নেট লাগানো বন্দুক ও ব্রেনগানের নল এবং ছাত্র-জনতাকে বোঝানোর জন্য মাটিতে পড়ে থাকা খোলা বই ও একজোড়া নগ্ন পায়ের পাতা আঁকা হয়েছে। এই লিনোকাটই প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, এই চিত্রটি ছাড়া আর কোনো শিল্পকর্ম একুশের ওপর ছিল না।

.
.

‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাট ছাড়া আরও দুটি ড্রইংও উল্লেখ করার মতো। দুটিই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আঁকা। এক কিষান-কিষানি দানবসুলভ এক জন্তুকে প্রতিহত করছে। চেক লুঙ্গি পরিহিত মানুষটির ডান হাতে উঁচিয়ে ধরা বল্লম, বাঁ হাতে তাকে প্রতিরোধ করে রয়েছে। কিষানির ডান হাতে কাস্তে এবং বাঁ হাতে উঁচু করে ধরা বাংলা বর্ণমালার প্ল্যাকার্ড। বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কিষান-কিষানিকে আমি বাংলার গণমানুষের প্রতিনিধি রূপে দেখানোর চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় ড্রইংটি বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক শহীদ মিনারের পাদদেশে এই বীভৎস জন্তু ভূলুণ্ঠিত। জন্তু হিসেবে আমি চিত্রায়িত করেছি ডাইনোসরকে। কিন্তু যে ডাইনোসরকে আমি চিত্রিত করেছি, তা মাংসাশী নয়, তৃণভোজী। তবু এর বিশাল ভয়ংকর রূপকে পাকিস্তানি আগ্রাসনের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত করেছি। এর আগে বাঙালি জাতির ওপর একাত্তরে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটনা ঘটবে, তা হয়তো একজন শিল্পী হিসেবে দূরদর্শন করেছিলাম ‘জননী ভূলুণ্ঠিত’ নামে ১৯৬৯ সালে আঁকা এক স্কেচে।

.
.

একাত্তরের প্রথম ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল জহির রায়হান সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য এক্সপ্রেস পত্রিকায় এবং অন্যটি ছাপা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদের চটি পুস্তিকা ‘সোনার হরিণ চাই’তে। শেষের ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের নিবেদিত ‘একুশে স্মরণে’ পুস্তিকায়। আরও কিছু বিক্ষিপ্ত ড্রইং করেছি, কিন্তু তার হদিস জানা নেই।

.
.

আজ একুশে চেতনা কোথায়? যদিও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি, এটুকুই সান্ত্বনা পাওয়ার মতো অর্জন। কিন্তু সেই চেতনা যে অপস্রিয়মাণ তা একটি ড্রইংয়ে প্রকাশ করেছিলাম। শহীদ চত্বর থেকে শহীদ মিনার পাখি হয়ে দূর আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। বেদির মাঝখানে লাল সূর্য থেকে বাংলার চেতনা ঝরে পড়ছে। জননী বাংলাদেশ ফুলের অর্ঘ্য নিয়ে একপাজো বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর একুশের ক্রোড়পত্রের প্রারম্ভের অলংকরণ ২০০৭-এ।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায়)