বর্ণ নিয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব

ঢাকায় বর্ণমেলার মঞ্চে সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম ও ইকরির পরিবেশনা
ঢাকায় বর্ণমেলার মঞ্চে সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম ও ইকরির পরিবেশনা

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অষ্টমবারের মতো প্রথম আলো দিনভর আয়োজন করেছিল বর্ণমেলা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে মাতৃভাষা নিয়ে এই বর্ণাঢ্য উৎসব। আয়োজনের সহযোগী ছিল ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড সার্ফ এক্সেল। সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল নাইন।

ঢাকায় সকালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মাঠে বর্ণমেলা উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

মাঠে স্থাপিত বর্ণে হাতে রং মেখে ছাপ দিচ্ছে শিশুরা
মাঠে স্থাপিত বর্ণে হাতে রং মেখে ছাপ দিচ্ছে শিশুরা

চট্টগ্রামে বর্ণমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। উদ্বোধন করেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক। রাজশাহীতে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।

দিনের শুরু থেকেই রোদ বেশ চড়া। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেজও বাড়ছিল। সঙ্গে ছিল দমকা হাওয়া। তাতে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছিল চারপাশের গাছগুলোর শুকনো পাতা। উড়ছিল ধুলো। কিন্তু কে ওসবের তোয়াক্কা করে এমন আয়োজনে? উঠতে হবে বর্ণ পাহাড়ে, আঁকতে হবে, নামতে হবে দৌড় প্রতিযোগিতায়। কাজেই রোদ-ধুলোর পরোয়া করলে চলে! খুদের দল পরমানন্দে মেতে উঠেছিল গতকাল মঙ্গলবার বর্ণমেলার উৎসবে।

ঢাকায় এবারের বর্ণমেলার উৎ​সবস্থল ছিল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। এবারের মেলার পরিসর অনেক বেড়েছে। মাঠের মাঝখানে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি বিচিত্র বর্ণের চমকপ্রদ প্রদর্শনী। ছিল বিশাল আকারের বর্ণমালা। সেগুলোতে ইচ্ছামতো রং করেছে খুদেরা।

বর্ণ নিয়ে মজার খেলা মেতে ওঠে শিশুরা
বর্ণ নিয়ে মজার খেলা মেতে ওঠে শিশুরা

মাঠের চারপাশ দিয়ে স্টলের সারি। পুবদিকের সারিতে সিসিমপুর, বেঙ্গল পাবলিকেশনসের স্টল। এরপর সার্ফ এক্সেলের স্টলগুলোতে টি-শার্টে নকশা করার আয়োজন, জলকামান ছুড়ে নিশানা তাক করার খেলা। উত্তরের বড় একটি অংশজুড়ে খাবারের দোকানের সারি। হাতেখড়ির স্টল। পশ্চিমে বর্ণ পাহাড়। সেখানে বাতাসে ফোলানো প্লাস্টিকের পাহাড়ে চড়া, স্লিপারে চড়া, লম্ফঝম্ফ করাসহ রকমারি আয়োজন। তারপর সবুজ ছাউনি। তার তলায় ছবি আঁকা আর দৌড়ের প্রতিযোগিতা। দক্ষিণে কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা, প্রথমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল। মাঠের উত্তর প্রান্তে বিশাল এক লাল ছাতার আকৃতির বর্ণমঞ্চ নামের মূল মঞ্চ। সেখান থেকে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সকালে সূচনা ভাষ্যে বললেন, ‘বর্ণ মানে রং, আবার বর্ণ মানে অক্ষর। বাংলা ভাষার এই বর্ণময় রঙিন উৎসবে সবার আমন্ত্রণ। এবার অষ্টমবারের মতো এই উৎসব হচ্ছে। ঢাকাসহ চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও এই উৎসব হচ্ছে।’

বর্ণ প্রদর্শনীতে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক শিশু
বর্ণ প্রদর্শনীতে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক শিশু

পশ্চিম পাশে সবুজ মঞ্চের পাশেই তৈরি করা হয়েছিল প্রতীকী শহীদ মিনার। সকালে সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বললেন একুশে আমাদের জাতীয় জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। একুশ আছে তাই বাংলাদেশ কোনো দিন পথ হারাবে না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, উপাধ্যক্ষ ফেরদৌস আরা বেগমকে শহীদ মিনারে ফুল দেন। তাঁদের সঙ্গে সেন্ট যাকোব স্কুলের শিক্ষার্থী ও দর্শকদের পুষ্পস্তবক অর্পণের ভেতর দিয়ে মেলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলো। পরে রঙিন বেলুনগুচ্ছ উড়িয়ে তাঁরা মেলার উদ্বোধন করেন।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা মেলার উদ্বোধন করে বলেন, ভাষার প্রতি যত্নবান হতে হবে। শুধু মাতৃভাষা নয়, কোনো ভাষা শিখতে হলে শুদ্ধ করে শিখতে হবে। ভাষার বিকৃতি রোধ করতে হবে। সব ভাষাকে সম্মান দিতে হবে। তিনি এই আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বর্ণমেলা এখন একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে ভাষার শুদ্ধ চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই ভাষাশহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো যাবে।

অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিটি বর্ণ আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রতীক। আজ এই উৎসবের মধ্য দিয়ে সেই বর্ণগুলো যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, কথা বলছে। এ ধরনের উৎসবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মনোজগতের বিকাশ ঘটবে।’

বর্ণমেলায় বিভিন্ন বিষয়ে বিজয়ী শিশুদের সঙ্গে অতিথিরা
বর্ণমেলায় বিভিন্ন বিষয়ে বিজয়ী শিশুদের সঙ্গে অতিথিরা

ওদিকে বর্ণমঞ্চে সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করলেন জাতীয় সংগীত। তাঁরা আরও গাইলেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা’। এরপর শিল্পী ফরিদা পারভীনের গানের দল অচিন পাখির শিল্পীরা গান করেন। আরও গান করেন শিল্পী অদিতি মহসিন ও প্রিয়াংকা গোপ। আবৃত্তি করেছে সানিডেল স্কুলের শিক্ষার্থী মীর ফরিয়ান মেহেবুব।

বর্ণমঞ্চে যখন অনুষ্ঠান জমে উঠেছে, তখন হাতেখড়ির স্টলে শিশুদের হাতেখড়ি দেওয়ার পর্ব। এতে অংশ নেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবুল বারক আলভী, ওয়াকিলুর রহমান, আফজাল হোসেন ও অশোক কর্মকার। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়েছে পশ্চিম পাশের সবুজ ছাউনির তলায়।

বর্ণমঞ্চের অনুষ্ঠানে পূজা সেনগুপ্ত ও তাঁর দল তুরঙ্গমীর শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন। গান করে ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আবৃত্তি করেছেন মাহমুদা আক্তার। ম্যাজিক দেখিয়েছেন আলী রাজ, পাপেট শো ছিল জল পুতুল’-এর। সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম, ইকরিকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে খুদে দর্শকেরা। আর ছিল প্রাচ্যনাটের বিশেষ পরিবেশনা আঠারো বছর

চট্টগ্রামের বর্ণমেলায় চোখ বে​ঁধে স্পর্শ করে বর্ণ চেনার খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা
চট্টগ্রামের বর্ণমেলায় চোখ বে​ঁধে স্পর্শ করে বর্ণ চেনার খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা

বিকেলের পর্বে ছোটদের জন্য জাদু নিয়ে মঞ্চে আসে খুদে জাদুকর সামিরা নূর শুভা। বর্ণ প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন ও হাতের লেখা প্রতিযোগিতার পুরস্কার দিতে মঞ্চে আসেন বিচারকেরা। এ পর্বের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর উপফিচার সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর।

‘এসো গল্প লিখি’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৩৫ জন খুদে লেখকের গল্প নিয়ে ‘গোল্লাছুট সেরা গল্প’ নামের বই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। গতকাল অনুষ্ঠান মঞ্চে হয় বইটির মোড়ক উন্মোচন।

এরপরই মঞ্চে আসে ব্যান্ড দল ‘জলের গান’। এরপর মঞ্চে আসেন সজীব ও ঐশী। গান গেয়ে শোনান মাহমুদুজ্জামান বাবু ও দিনাত জাহান।

একদিকে মঞ্চে চলছিল শিল্পীদের পরিবেশনা, তখন বিভিন্ন বয়সী শিশুরা মেতে উঠেছিল বর্ণ দৌড়ে। অনূর্ধ্ব এক বছরের শিশুদের জন্য ছিল হামাগুড়ি প্রতিযোগিতা। ৫ বছরের কম খোকা-খুকিরা নামে বর্ণ দৌড়ে। ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে ছিল প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা।

রাজশাহীতে বর্ণমেলায় শিশুদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা
রাজশাহীতে বর্ণমেলায় শিশুদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা

বর্ণমেলাতে আয়োজন ছিল ‘বর্ণায়ন’ নামে শিশুদের টি-শার্টে নকশা করার সুযোগ। যার যার আঁকা টি-শার্টটি ছিল প্রাথমিক উপহার। এ ছাড়া বর্ণায়নে আঁকা টি-শার্টগুলোর মধ্য থেকে ৩টি টি-শার্টকে দেওয়া আলাদা পুরস্কার। বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেন নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান।

সোবহানবাগ থেকে তিন মেয়েকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন আল-হামরা নাসরিন। বর্ণায়নে অংশ নিয়ে বেশ খুশি তাঁর মেয়েরা। নাসরিন বললেন, ‘বর্ণ নিয়ে এত বড় আয়োজন বেশ ভালো লাগে।’

দেশাত্মবোধক গান শোনান ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সাব্বির। এরপর দুটি গান করেন শিল্পী তপন চৌধুরী। শিল্পী কোনাল ও ইমরানের গানের পর দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল শিল্পী কনার। তাঁর গানের তালে তালে শেষ হয় এবারের ঢাকার বর্ণমেলা।

ঢাকার বর্ণমেলায় রং–তুলিতে নকশা অাঁকায় মগ্ন এক খুদে
ঢাকার বর্ণমেলায় রং–তুলিতে নকশা অাঁকায় মগ্ন এক খুদে

চট্টগ্রামে

চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন রক্তকরবীর শিল্পীরা। পরে বোধন আবৃত্তি পরিষদ ও প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করেন। গান করেন অভ্যুদয় সংগীত অঙ্গনের শিল্পীরা। প্রাপন একাডেমির শিল্পীরা পরিবেশন করেন বৃন্দ নৃত্য। জাদু প্রদর্শন করেন রাজীব বসাক। বাউলগান পরিবেশন করেন মানস পাল। এরপর ছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সিলভার বেলস হাইস্কুল, মেরিট বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মেরন সান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন অরিন, চৈতী মুৎসুদ্দী, নিশীতা বড়ুয়া, হৈমন্তী রক্ষিত, ব্যান্ড দল সাসটেইন ও চিরকুট।

রাজশাহীতে

রাজশাহীতে বর্ণমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বেহালায় একুশের গানের সুরে তোলেন ইকবাল মতিন। আবৃত্তি করে রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদের খুদে আবৃত্তিশিল্পীরা। সংগীত পরিবেশ করেন রেজাউল করিম এবং রেখা পারভীন।

আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করে রাজশাহী সরকারি পিএন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। গান ও নাচের পরিবেশনা ছিল রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া নগরের বিভিন্ন স্কুলের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গীত পরিবেশন করে। নৃত্য পরিবেশন করেন ল্যাডলী মোহন মৈত্র ও আলো রানী মৈত্র। জাদু প্রদর্শন করেন স্বপন দিনার। বিকেলে গান করেন সাজেদ ফাতেমী, অঙ্কন, পায়েল, মেহেদী, রোমেল, আরিফ, রাফাত ও ইতি। অনুষ্ঠানে সবশেষে ছিল ব্যান্ড দল আনন্দনগরের পরিবেশনা।