অপহরণ চক্রের সঙ্গে শিশু বায়েজিদের ২১ দিন

শিশু বায়েজিদ অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ছয় আসামি। এঁরা হলেন (ওপরে বাঁ থেকে) জাকির হোসেন, টিটু, দেলু, (নিচে বাঁ থেকে) মর্জিনা, জেসমিন ও আসলাম। ছবি: সংগৃহীত
শিশু বায়েজিদ অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ছয় আসামি। এঁরা হলেন (ওপরে বাঁ থেকে) জাকির হোসেন, টিটু, দেলু, (নিচে বাঁ থেকে) মর্জিনা, জেসমিন ও আসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রোজ সকালে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করে রাখত। ঠিকমতো খাবার দিত না। তার মতো আরও অনেক বাচ্চাকে এভাবে অচেতন করে আটকে রাখা হয়েছিল। একদিন তার সামনেই দুটি শিশুর লাশ বস্তায় ভরা হয়। অপহরণকারী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার হওয়ার পর মা ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কাছে এমন রোমহর্ষক তথ্য দিয়েছে ছোট্ট বায়েজিদ (৮)।

বায়েজিদের মা ডালিম ও র‍্যাব-১১-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলেপ উদ্দিন অপহরণের শিকার বায়েজিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে প্রথম আলোকে জানান, ছোট এই শিশুটিকে প্রতিদিন ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। ২১ দিন সে অপহরণকারী চক্রের হাতে আটক ছিল। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাসারী এলাকায় অবস্থিত একটি বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। ওই বাড়িতে দুই শিশুসহ চারজনকে খুন করেছে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা।

শিশু বায়েজিদ নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর। বায়েজিদের খোঁজে র‍্যাব কাজ করছে জানার পর অপহরণকারীরা অচেতন অবস্থায় তাকে গত ১৮ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড বাসস্ট্যান্ডের পাশে ডেমরা রোডে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে বায়েজিদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন সে মায়ের সঙ্গে বন্দর এলাকায় বসবাস করছে। তার মা একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। বায়েজিদের বাবা কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। অপহরণের দিন সকাল নয়টায় দুধ কিনতে ঘর থেকে বের হয় শিশু বায়েজিদ। রাস্তায় ওঠা মাত্রই একটা মাইক্রোবাস তাকে তুলে নেয়।

র‍্যাব-১১-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলেপ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়েজিদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, রাস্তায় একটি কালো মাইক্রোবাস দাঁড়িয়েছিল। এর সামনে ছিল একটা অ্যাম্বুলেন্স। হঠাৎ কালো গাড়িটি থেকে নেমে এক লোক তার মুখ চেপে ধরে গাড়িতে ওঠায়। পরে মুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধে। সেখানে ইনজেকশন দেয়। গাড়িতে আরও দুটি শিশু ছিল। একটি বাসায় নিয়ে শিশুদের ইনজেকশন পুশ করতেন দুই নারী।’

আলেপ উদ্দিন বলেন, দেলু ও টিটু নামের দুই ব্যক্তি বায়েজিদকে অপহরণ করেন। বায়েজিদের খোঁজে রাস্তায় পাগলের মতো ছুটেছিলেন তাঁর মা ডালিম। অপহরণকারী চক্র ডালিমের কাছে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জের জাকির হোসেনসহ অপহরণ চক্রের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন বায়েজিদের মা ডালিম।
আলেপ উদ্দিন বলেন, বায়েজিদকে অপহরণ করার পর তার মা একদিন তাঁর কাছে আসেন। তিনি জানান, অপহরণকারীরা তাঁর মুঠোফোনে মুক্তিপণ চেয়েছে। যে নম্বর থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল, সেই নম্বরে তিনি নিজে ১ হাজার ৫০০ টাকা পাঠান। পরে সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাসারী এলাকা থেকে ওই টাকা তোলেন টিটু নামের এক অপহরণকারী। পরে টিটুকে কমলাপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। টিটুই সিদ্ধিরগঞ্জের শিশুদের অপহরণ করে আটক রাখার এই আস্তানার সন্ধান দেন। সেখান থেকে শিশু অপহরণকারী চক্রের সদস্য আর স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগম ওরফে বানেছাকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘বায়েজিদের কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি, অপহরণের শিকার দুটি শিশুকে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে ফেলে দিয়েছে অপহরণকারী চক্র। ওই চক্রের দুই নারী সদস্য রোজ সকালে বায়েজিদকে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করে রাখতেন। রাতের দিকে মাঝেমধ্যে জ্ঞান ফিরে আসত। ঠিকমতো খাবার দিত না। একেক দিন একেক বাসায় রাখত। ওই চক্রের চারতলা ও পাঁচতলা দুটি বাড়ি দেখেছে সে। ওই বাড়ি দুটিতে আরও অনেক বাচ্চাকে আটকে রাখতে দেখেছে সে।’
তিনি জানান, দুই বছর ধরে অপহরণকারী দলের সদস্য দেলু, টিটু, জাকির, বানেছা, জেসমিন, কবিররা প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশু অপহরণ করেছে। দুটি শিশুকে তারা খুনও করেছে। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি শিশু অপহরণ ও শিশু পাচার করছিল তারা।

বায়েজিদের মা জানান, অপহরণকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করায় এখন তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মামলা করার পর কালু নামের এক লোক তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। মামলা করে কোনো লাভ হবে না বলেও হুমকি দিচ্ছেন। ছেলেকে নিয়ে তিনি এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, হুমকিদাতা কালু অপহরণকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে।