যে পতাকা আর কখনো নামেনি

পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পশ্চিম গেটের (ডিন গেট) সামনে কেউ দাঁড়ালেই দেয়ালে একটি ম্যুরাল দেখতে পাবেন। তাতে সবুজের মাঝে লাল এবং তার ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্র—এমন একটি পতাকাকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলার ছবির ভিত্তিতে তৈরি ম্যুরাল। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ওড়ানো হয়েছিল বাংলাদেশের এই জাতীয় পতাকা।

বর্তমান ছবি
বর্তমান ছবি

সেদিনের সেই ছবিটি আছে আলোকচিত্র সংকলন নিয়ে প্রকাশিত বই ঢাকা ১৯৪৮-১৯৭১ গ্রন্থে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সরকার গঠনের আহ্বান জানানোর পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার সময়ক্ষেপণ করছিল। একপর্যায়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে বলে ঘোষণা দেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মার্চ পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি খসড়া সংবিধান নিয়ে আলোচনা হয়। পূর্বাণী হোটেলে এই বৈঠক চলাকালেই ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা দেন। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকার মানুষ। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাজারো মানুষ পূর্বাণী হোটেলে ছুটে যায় মিছিল নিয়ে। সবার কণ্ঠে স্লোগান ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রনেতারা ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-গণসমাবেশ আহ্বান করেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ছাত্রলীগ নেতারা আলোচনা করে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ২ মার্চ সকাল থেকেই দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়। সব মিছিলের একটিই লক্ষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন বেলা ১১টায় গাঢ় সবুজ জমিনের মাঝখানে লাল বৃত্তে অঙ্কিত মানচিত্র ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’ প্রথম উত্তোলিত হয়। ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকেই সারা দেশে এই পতাকা উত্তোলিত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ঢাকার সর্বত্র এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীনতাসংগ্রামের নয় মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয় আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে। এই পতাকা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে শহীদদের পবিত্র দেহ জড়িয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হতো। এখনো কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন গেটে গেলে পতাকা তোলার স্থানে একটি ফলক দেখতে পাবেন, যাতে লেখা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এখানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। আসলে সেই যে ২ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছে, সেটি আর কখনো নামেনি।
লেখা: শরিফুল হাসান, ছবি: হাসান রাজা